স্থায়ী পে-কমিশন গঠনসহ ২৫ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ইতোমধ্যেই তারা তাদের ২৫ দফা দাবির সমর্থনে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে প্রচারপত্র। আগামী বছরের শেষে অথবা পরের বছরের প্রথম সপ্তাহে দেশে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই সময়ের মধ্যে আন্দোলনের আড়ালে কোনও প্রকার নাশকতা বা অস্থিরতা যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সতর্ক বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ২৫ দফা দাবির প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সহানুভূতি রয়েছে। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায়ও রয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। সূত্র জানায়, সরকার ইতোমধ্যেই সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগেই হয়তো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। এ জন্য তাদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন বা আন্দোলন করতে হবে না।
তবে ২৫ দফা দাবি উপস্থাপনকারী বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পেলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়েনি। তাই স্থায়ী পে-কমিশন গঠন এবং নতুন পে-কমিশন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদানের দাবিসহ ২৫ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মদ তোয়াহা জানিয়েছেন, এটা কোনও আন্দোলন বা সংগ্রামও নয়। আমরা আমাদের দাবি উপস্থাপন করেছি মাত্র। এখন এগুলো কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা সরকারের বিষয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিশ্চয়ই সরকারের সংশ্লিষ্টরা আমাদের সুসংবাদ দেবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনা। এখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব সময়েই সতর্ক থাকতে হয়। এটা নতুন কিছু নয়। তবে দাবি দাওয়া উপস্থাপন এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার নামে যাতে কোনওভাবেই অস্থিরতা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে আমরা সতর্ক।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আলী ইমাম মজুমদার জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন এবং এগুলো আদায়ের জন্য আন্দোলন অতীতেও হয়েছে। তবে এগুলোকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে প্রশাসনে অস্থিরতা বা সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সরকারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব মোহম্মদ তোয়াহা স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্রে এই ২৫ দফা দাবি জানানো হয়। তাদের ২৫ দফা দাবি হচ্ছে—স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করতে হবে এবং পে-কমিশনে কর্মচারী সংগঠনের প্রতিনিধি রাখতে হবে। নতুন পে-কমিশন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান করতে হবে। বেতন স্কেল ২০ ধাপ ভেঙে ১২ ধাপ বিশিষ্ট বেতন স্কেল প্রদান করতে হবে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ এর স্থলে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। পূর্বের ন্যায় শতভাগ পেনশন প্রদানসহ ০১ টাকার বিনিময়ে ৫০০ টাকা গ্রাচ্যুইটি নির্ধারণপূর্বক পেনশন প্রদান করতে হবে। পূর্বের ন্যায় টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করতে হবে।
এছাড়া পে-কমিশনে বাড়িভাড়া ৮০ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা ৫০০০ টাকা, শিক্ষাভাতা ৩০০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ২০০০ টাকা, টিফিনভাতা ৩০০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পদে ১৪৫ হারে বেতন স্কেল নির্ধারণ করে বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ এর স্থলে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। বৈশাখী ভাতা ১০০ শতাংশ করতে হবে এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ভাতা ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ভাতা প্রদান করতে হবে। সরকারি দফতরে আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং ইতিমধ্যে আউটসোর্সিং ও প্রকল্পে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করতে হবে। সরকারি চাকরিতে সরাসরি প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর এর স্থলে ৩৫ বছর এবং বিভাগীয় প্রার্থীদের সরকারী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়স সীমা ৪০ বছর পর্যন্ত শিথিল করতে হবে। অবসরের বয়স সীমা ৫৯ এর স্থলে ৬৫ বছর করতে হবে। জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর শ্রেণি বিন্যাস বিলুপ্ত করে গ্রেড প্রথা চালু করা হয়েছে। যে কর্মচারী যে গ্রেডে বেতন ভাতা প্রাপ্য হন তাকে সেই গ্রেডের পদমর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। ব্লক পদ প্রথা প্রত্যাহার করে সকল পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। সুইপার, গার্ড, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ফরাসদের গাড়ি চালকদের ন্যায় ওভার টাইম প্রদান করতে হবে।
গাড়ি চালক, ডি আর, লিফটম্যান, ইলেক্ট্রিশিয়ানদের ঝুঁকি ভাতা প্রদান করতে হবে। সচিবালয়ের কর্মচারীদের ১০ শতাংশ সচিবালয় ভাতা প্রদান করতে হবে। কর্মচারীদের সন্তানদের চাকরির লক্ষ্যে পোষ্য কোটা ৩০ শতাংশ এবং সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তির জন্য ২০ শতাংশ কোটা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকর্তাদের ন্যায় কর্মচারীদেরকে যোগ্যতা অনুসারে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। কল্যাণ তহবিলে মাসিক ভাতা দুই হাজার টাকার পরিবর্তে সাত হাজার টাকা করতে হবে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সিভিল কর্মচারী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রতিরক্ষা অডিটরদের ন্যায় সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য রেশনিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। সচিবালয়ে সহকারী সচিব পদে পদোন্নতিতে ফিডার পদের বৈষম্য দূর করে একই ফিডার পদ নির্ধারণ করতে হবে। সচিবালয়ে কর্মরত অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটরদের পদবী পরিবর্তন পূর্বক সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা করতে হবে এবং ক্যাশ সরকারের পদ পরিবর্তন করে ক্যাশ অফিসারে নামকরণ করতে হবে। নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের গৃহ নির্মাণ ও মোটর সাইকেল কেনার জন্য সুদ মুক্ত ঋণ প্রদান করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের রাষ্ট্রীয় সফরে অন্যান্য পেশার ন্যায় কর্মচারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে এবং সচিবালয় কর্মচারী সমিতির নামে জায়গা বরাদ্দ পূর্বক কর্মচারী ভবন নির্মাণ করতে হবে।।
বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ বলেছে, জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ বাস্তবায়নের পর তেল, গ্যাস বিদ্যুৎসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারি কর্মচারীরা আজ দিশেহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেলেও গত সাত বছর ধরে পে-স্কেল না দেওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পায়নি। তাই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে জাতীয় পে-স্কেলের পূর্বের ন্যায় কমিটি গঠন করে নতুন স্কেল কার্যক্রম চালু করাসহ এই ২৫ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে।