দেরিতে হলেও রাজধানীর অলিগলিতে ঘিঞ্জি পরিবেশে ছড়ানো ছিটানো তিন হাজার মুদ্রণ শিল্পকে (ছাপাখানা) একই স্থানে সরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের কেয়াইনে দেড়শ’ বিঘা (৫০ একর) জমির ওপর ‘বিসিক মুদ্রণ শিল্প নগরী’ নির্মাণ হচ্ছে। এ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে সম্প্রতি পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। খুব শিগগিরই একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সামান্য টাকায় ৪১৯টি বরাদ্দ পাওয়ায় উদ্যোক্তারা একাট্টা নতুন পরিবেশবান্ধব ঠিকানায় যেতে। তারা বলছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে তৈরি পোশাক শিল্পের পরই ছাপাখানা শিল্প শতভাগ রফতানিমুখী হবে। এতে রফতানি আয়ও অনেক বেড়ে যাবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ছাপাখানার মধ্যে রাজধানীর আরামবাগ, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, পল্টন, বাংলাবাজার, বাবুবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুর, ইসলামপুর, জিন্দাবাজার, কাঁটাবন, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তিন হাজারের মতো। এসব ছাপাখানাতেই দেশের বই, ডায়েরি, সাময়িক পত্রিকা, খাতা, প্যাড, লেবেল, লিফলেট, ভিজিটিং কার্ডসহ অন্যান্য ছাপার চাহিদা মেটানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়. দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বে মোট রফতানিতে ৯ শতাংশ অবদান রাখছে। আর এ কাজ করতে গিয়ে একদিকে পরিবেশের বিপর্যয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত দূষণও বাড়ছে। কারণ পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে অধিকাংশ ছাপাখানায় ঘিঞ্জি পরিবেশেই ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে।
তাই মুন্সীগঞ্জে এক জায়গায় স্থানান্তরের সরকারি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ছাপাখানা ব্যবসায়ীরা একাট্টা দ্রুত চলে যেতে পরিবশবান্ধব পরিবেশে। এ ব্যাপারে বাংলাবাজারের সাহিত্যবিতান প্রেস ও পাবলিকেশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল ইসলাম (বাহার) এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘিঞ্জি পরিবেশের দেয়ালে আর ভালো লাগে না। খরচ যেহেতু হচ্ছে না। নামেমাত্র সামান্য খরচে প্লট বরাদ্দ পাওয়া যাবে। এতে কারো অনীহা থাকারই কথা না। তাই তো আমরা চাচ্ছি এটি দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আমরা নতুন স্থানে যেতে চাই। তার কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয়াপল্টনে অবস্থিত সঞ্জনা প্রিন্টার্সের মালিক ও বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত মানবকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রাজধানীর ঘিঞ্জির দেয়াল ছেড়ে পরিবেশবান্ধব কোনো এক জায়গায় স্থানান্তরের। অনেক দেরিতে হলেও সেই দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে, বিসিক মুদ্রণশিল্প নগরী মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। এর ফলে কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে এ শিল্প। অন্য এক প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, নতুনভাবে মুদ্রণ শিল্পনগরী হলে তৈরি পোশাক শিল্পের পরই শতভাগ রফতানিমুখী শিল্প হবে এটি। এতে রফতানি আয়ও অনেক বেড়ে যাবে। কারণ ফাস্টফুড, ওষুধশিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পণ্য সরবরাহ করছি। শুধু তাই নয়, দেশের চাহিদা মিটিয়ে মোট রফতানির ৯ শতাংশ আয় করছি এ শিল্প থেকে। তাই পরিবেশবান্ধব ছাপাখানা নগরী নির্মাণ বাস্তবায়িত হলে রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে যাবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যেভাবেই হোক নগরী থেকে সব ছাপাখানা বাইরে স্থানান্তর করা হবে। এরই অংশবিশেষ আলাদাভাবে ছাপাখানা শিল্পনগরী গড়ে তুলতে ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট শিল্প মালিকদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
ওই চুক্তিতে বলা হয়, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নে প্রায় ৫০ একর জমিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপির ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে ‘বিসিক মুদ্রণশিল্প নগরী’। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যয় করবেন ৯০ শতাংশ ও সরকার ১০ ভাগ। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৯৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর নির্মাণকাল ধরা হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর। এতে ঢাকার ছাপাখানা ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মাণ করা হবে ৪ টাইপের ৪১৯টি শিল্পপ্লট। এ টাইপের ৬ হাজার বর্গফুটের থাকবে ৩৭টি শিল্পপ্লট, বি টাইপের ৭৭টি, সি টাইপের ২৫৩টি এবং বিশেষ টাইপের ২ হাজার ৮১০ থেকে ৬ হাজার ৫২৫ বর্গফুটের ৫২টি প্লট নির্মাণ করা হবে। বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন-বিসিক।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি তৈরি করে আর্থিক ব্যয় অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তা যাচাই-বাচাই করতে কমিশনে গত ২০১৪ সালে ২২ জুনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি-পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হলে বিভিন্ন ঝামেলা ও দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে অবশেষে পিপিপির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নেই এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিশন থেকে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে বলা হলে সেই ধারাবাহিকতায় দেরিতে হলেও অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জে ছাপাখানা নগরী। কারণ সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো পিইসি সভাও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য কাজ শেষ করে খুব শিগগিরই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানায়।
Prev Post
Next Post