‘সাতসকালে ভদ্রলোক উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন শিলং গলফ ক্লাবের সামনে রাস্তায়। চোখের চাহনিও একটু অদ্ভুত। যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, এলাকায় অপরিচিত ওই ভদ্রলোকের সন্দেহজনক গতিবিধি দেখে স্থানীয়রাই পুলিশে খবর দেন।’
সোমবার ভোরে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিক সালাহ উদ্দিন আহমেদকে পাওয়া গেল, বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই কাহিনীই শোনাচ্ছিলেন ইস্ট খাসি হিলসের পুলিশ সুপার এম খারক্রাং। ‘মেঘালয় পুলিশ সার্ভিসে দীর্ঘ কর্মজীবনেও এমন ‘কেস’ খুব কমই পেয়েছি’, হাসতে হাসতে বলছিলেন এই অভিজ্ঞ পুলিশকর্তা।
নাটক, কারণ ওই ভদ্রলোক থানায় গিয়েই বলতে শুরু করেন, ‘দেখুন আমি কিন্তু বাংলাদেশের একজন ভিআইপি। আমি সে দেশে ক্যাবিনেট মিনিস্টারও ছিলাম!’ এদিকে ভদ্রলোকের পকেটে একটা কাগজ পর্যন্ত নেই। কোনও টাকাপয়সা দূরে থাক, পকেটে একটা মানিব্যাগও নেই, ফলে যথারীতি শিলংয়ের পুলিশ প্রথমে তার কথা একেবারেই বিশ্বাস করেনি, পাগলের প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দিয়েছিল।
‘আচ্ছা বুঝলাম আপনি বাংলাদেশে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু বর্ডার পেরিয়ে আপনি শিলং অবধি এলেন কী করে?’
পুলিশের এই প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক আবার ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মুখে কোনও কথা জোগায় না। ওনার অবস্থা দেখে থানাতেই সিদ্ধান্ত হয় ইনি নিশ্চয় মানসিক ভারসাম্যহীন, আর তারপরই পুলিশ তাকে শিলংয়ের মিমহ্যানসে (মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল সায়েন্স) ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করে। মিমহ্যানস শিলংয়ে মানসিক প্রতিবন্ধীর হাসপাতাল বলেই পরিচিত। সালাহ উদ্দিন আহমেদের গতি হয় সেখানেই।
‘তবে একটা কথা কী, ভদ্রলোক বাংলাদেশি কি না কিংবা সালাহ উদ্দিন আহমেদ কি না সেটা কিন্তু আমরা এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। ওনার কাছে কোনও কাগজপত্র নেই। ওর কোনও আত্মীয় পরিজন এসে ওকে এখনও চিহ্নিতও করেননি। ফলে আপাতত ওনাকে একজন বিদেশি নাগরিক বলে চিহ্নিত করে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার জন্য ফরেনার্স অ্যাক্টে আমরা রীতিমাফিক মামলা রুজু করেছি’, জানাচ্ছিলেন পুলিশ-প্রধান এম খারক্রাং।
তাহলে কীভাবে জানা গেল সালাউদ্দিন আহমেদ শিলংয়ের হাসপাতালে ভর্তি আছেন?
আসলে মিমহ্যানসে ডাক্তারদের চিকিৎসায় গতকাল রাত থেকেই অল্প অল্প করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার লক্ষণ দেখাতে শুরু করেন তিনি। তারপর আজ সকালে তিনি মিমহ্যানসের ডাক্তারদের জানান, ঢাকায় তার স্ত্রীর টেলিফোন নম্বর তার মনে পড়েছে– সেখানে তিনি ফোন করে কথা বলতে চান। এরপরই তিনি ঢাকায় স্ত্রী হাসিনা আহমেদকে ফোন করে জানান, তিনি ভাল আছেন, মেঘালয়ের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।
সোমবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন শিলং গলফ ক্লাবের সামনে থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে, তখন তিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় থাকলেও তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তবে মিমহ্যানসে চিকিৎসকরা এদিন তাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন তার হৃদযন্ত্রে কিছু দুর্বলতার লক্ষণ আছে। ফলে মানসিক হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নিয়ে এদিন বিকেলে তাকে শিলং সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কিন্তু সালাউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধারের জিগ-স পাজলে যে রহস্যটা এখনও ধোঁয়াশায় ঘেরা, তা হল তিনি শিলংয়ে উদয় হলেন কীভাবে? পুলিশ-সুপার আমার কাছে স্বীকার করেছেন, ব্যাপারটা তাদেরকেও ধন্দে রেখেছে।
আসলে শিলংয়ের সবচেয়ে কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের ডাউকি– সেটাও প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ মাইল দূরে। প্রাথমিকভাবে মেঘালয় পুলিশ অনুমান করছে রবিবার রাতে সেই ডাউকির কাছে সীমান্ত পেরিয়েই ভারতে ঢোকেন সালাউদ্দিন আহমেদ– কিংবা তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়! তারপর সেখান থেকে কোনও বাস বা ভাড়ার টেম্পোয় চেপে তিনি সোমবার ভোরে শিলংয়ে পৌঁছান এবং কিছুক্ষণ পর পুলিশের কাছে ধরা পড়েন।
কিন্তু এই সময়টাও তিনি আদৌ স্বাভাবিক বা প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিলেন না। খুব জোরালো ইলেকট্রিক শক খেলে বা অন্য কোনও শক থেরাপির মানুষের যেমন সাময়িক মস্তিষ্ক বৈকল্য হয় তার মধ্যেও সেরকমই লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। মিমহ্যানসের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন ওই রোগীকে সম্প্রতি ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে বলেই তারা অনুমান করছেন।
এখন সালাহ উদ্দিন আহমেদের ব্যাপারটি নিয়ে মেঘালয়ের পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কীভাবে মামলা এগোবে এবং তাকে নিয়ে কী করা হবে মেঘালয় সরকার বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কথাবার্তা বলছেন। তার পরিচয় সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেই যোগাযোগ করা হবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গেও। খুব সহজে যে এই মামলার জট খুলবে না তা বোঝাই যাচ্ছে।