সূর্য ডুবলেই শেষ? মেয়েরা আর বাসে উঠবে না?

0

Sun girlsঢাকা: পল্টন মোড়। রাত ৯টা। টিপটিপ বৃষ্টি। একটু পরপর মেঘের গর্জন। এক্ষুণই হয়তো নামবে মুষলধারে বৃষ্টি। চারপাশে সবারই জলদি বাসায় ফেরার তাড়া। আরো অনেকের মতো অবন্তীও দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের অপেক্ষায়। বাস আসছে, যাচ্ছে, মানুষ দৌড়াচ্ছে, বাসে উঠছে, ঝুলছে। কিন্তু আধা ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অবন্তী কোনো বাসে জায়গা করতে পারলেন না।

ঘড়ঘড় শব্দ করে গুলিস্তান থেকে মিরপুরামী একটার পর একটা বাস ঠিকই যাচ্ছে কিন্তু অবন্তীর জায়গা হচ্ছে না। কেন? কোনো বাসে তিনি উঠতে পারছেন না ভিড়ের কারণে। কোনো বাসে উঠতে গেলে হেলপার বলে উঠছে, ‘আফা মহিলা সিট নাই, উঠা যাইবো না।’ কোনো বাসের চালক আবার বলে উঠছেন, ওই ‘মহিলা’ উঠাইস না, প্যাসেঞ্জার ক্যাঁচাল করবো। পিছিয়ে থাকছেন না বাসে জায়গা করে নেয়া পুরুষ যাত্রীরাও। তারাও বলছেন, ওই হেলপার ‘মহিলা’ উঠাইস না…সিট ছাড়তে পারুম না।

অবন্তীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানালেন, বেসসরকারি একটা কোম্পানিতে কাজ করেন, অফিস শেষে বের হতে হতে রাত ৯টা হয়ে যায়। প্রতিদিন এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। কোনো যাত্রীর করুণা, কারো তাচ্ছিল্য, কারো বিরক্তিকর দৃষ্টি, কারো কৌতুহল, কারো লোলুপ দৃষ্টি। প্রতিদিন এগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করেই বাসে যাতায়াত করতে হয় তাকে।

এই গল্প অবন্তীর একার নয়। ঢাকা শহরে বাসে যাতায়াত করতে হয় যে নারীদের, তাদের প্রত্যেকেরই কম-বেশি এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর কোনো প্রয়োজনে যাদের বাসে উঠতে হয় সন্ধ্যার পরে তাদের তো রয়েছেই।

ইন্টারনেট-কম্পিউটার বা মানুষের মঙ্গলযাত্রার এই যুগে জীবিকার তাড়নায় বা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার জন্য কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান তালে ছুটে যাচ্ছেন নারীরা। সব ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজের যোগ্যতা দিয়েই  নিজের জায়গা করে নিতে হচ্ছে তাকে।

ঘনবসতির এই ঢাকা শহরে প্রতিদিনের কাজে এমনিতেই মানুষকে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। বছরের পর বছর ধরে এই দুর্ভোগ নিয়ে চলতে চলতে মানুষগুলো সেসবে খানিকটা অভ্যস্তই হয়ে গেছে। তবে ওই সমস্ত দুর্ভোগের সঙ্গে নারীকে প্রতিদিন যে ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাতে চলার পথে তাদের পড়তে হয় বিড়ম্বনার মধ্যে।

রাজধানীতে চলাচলকারী প্রত্যেক বাসেই নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঁচ থেকে নয়টি আসন সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই ওই আসনগুলো চলে যায় পুরুষদের দখলে। এই সময়ে কোনো নারীযাত্রীকে বাসে তুলতে এক ধরনের অনীহা দেখা যায় হেলপারদের মধ্যে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনটিও যেন সন্ধ্যার পর না ছাড়াই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করেন অনেক পুরুষ।

শহরে সূর্য ডোবার পর কোনো নারী বাসে উঠে সিট চাইলে তাকে সমালোচনার মধ্যেও পড়তে হয়। ব্যাপারটা যেন- এত রাতে বাইরে কী?

এ বিষয়ে ফার্মগেটে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ফারহানা জাহান বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি রাতে অফিস থেকে যখন বের হই তখন প্রতিদিন বাসে উঠতে আমার আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টাও লেগে যায়। বেশির ভাগ বাস উঠাতে চায় না মহিলা যাত্রী বলে। দিনে যেমন করেই হোক বাসে ওঠা যায়, রাত হলে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয় কীভাবে বাসে উঠবো?’

তিনি বলেন, রাতে যতটা না বাসের কর্মচারীরা ওঠাতে চায় না, তার থেকে যারা ‘মহিলা সিটে’ বসে থাকে সিট ছাড়ার ভয়ে হেলপারকে নারীযাত্রী তুলতে নিষেধ করেন।

এসবের মধ্যে জোর করে কোনো নারী যদি বাসে উঠেও যান তারপর পুরুষ যাত্রীরা হেরপারকে গালিগালাজ শুরু করে। ‘মহিলা উঠাইসোশ ক্যান’ জাতীয় নানা প্রশ্ন শুরু করেন।

ফারহানা সহজ, সোজা-সাপ্টা প্রশ্ন, ‘আরে বাবা আমাদের বাসে উঠতে না দিলে যাতায়াত করবো কীভাবে?’

আরেক কর্মজীবী নারী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘বাসে উঠে মহিলা সিটে কোনো পুরুষ বসে থাকলে তাকে উঠতে বললে এমন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকে যেন কাউকে দেখছে না।’

অনেকে যে আবার উল্টো প্রশ্ন করে বসেন সে বিষয়টি উঠে আসে সাবিনার কথায়। তিনি বলেন, ‘অনেকে আবার বলে, অ্যাতো রাইতে কীসের পুরুষ, কীসের মহিলা….সারাদিন তো আপনাগো সিট ছাইড়াই দিলাম।’

এর পাশাপাশি চারপাশ থেকে আসে- নারীদের বাসের সাধারণ আসনে বসার ‘যুক্তি’, নারী-পুরুষ সমঅধিকার প্রসঙ্গও। এভাবে নানাভাবে তাদের বিড়ম্বনায় ফেলা হয়।

বাসে সমঅধিকারের প্রসঙ্গ আসা নিয়ে সাবিনার অভিযোগ, ‘এমনি সময়ে সমঅধিকার নিয়ে কথা না বললেও বাসে মহিলা সিটে বসা নিয়ে সমঅধিকার প্রশ্ন তুলে নানা ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পুরুষ যাত্রীরা।’

ব্যাংকার সোনিয়া হাসান বলেন, ‘যেখানে দিনের বেলা বাসে দাঁড়িয়েই নারীকে যৌন হয়রানির মুখে পড়তে হয়, সেখানে রাতে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা কতটা নিরাপদ এটা সবার ভাবা উচিৎ। তাছাড়া রাতে তেমন নারী যাত্রী থাকে না, এ কারণে পুরুষরা মহিলা সিটটা ছেড়ে বসলে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। পুরুষ যাত্রীরা একটু সহযোগিতা করলে আমরাও নিরাপদে যাতায়াত করতে পারি।’

ঢাকা শহরে বাস চলতে নারীদের যেমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, পুরুষদের জন্যও ওই যাত্রা অনেকক্ষেত্রেই সুখকর হয় না। বাসের সিঁড়িতে কোনো রকমে একটা পা ফেলতে পারলেই যেন যাত্রা শুরু হয় পুরুষের। এরপর বাসের মধ্যে যাত্রীদের চাপাচাপি, ধাক্কাধাক্কি তো থাকেই।

এই অসুবিধার বিষয়টি নারীরাও বোঝেন। মনিরা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বাসে নারী দাঁড়িয়ে থাকলে সব যাত্রীর সমস্যা হয়। নারী-পুরুষ চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকলে উভয়েরই অস্বস্তি লাগে। তাছাড়া একজন নারীর স্থানে তিন জন পুরুষ বাসে দাঁড়াতে পারেন। এ কারণে আমার মনে হয় বাসে মহিলা সিটের সংখ্যা বাড়ানো উচিৎ।’

উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘সিডো’ বা ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ আইন’ নামের একটি সনদ গৃহীত হয়। আর বাংলাদেশ ওই সনদে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর। জাতিসংঘের সনদে উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যা বৈষম্য বলে বিবেচিত হবে না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More