ঢাকা: এক বছর আগে মার্চ-এপ্রিল মাসজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অরাজনৈতিক দাবিদার ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ৬ এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচির পর হেফাজতকে মনে করা হতো একটি ‘নতুন শক্তি’। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ৫ মে শাপলা চত্বরে ক্র্যাকডাউনের পর হেফাজত অনেকের কাছে ‘খলনায়ক’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি সংগঠনটি। বেশ কয়েক বার কর্মসূচি দিয়েও সরে আসতে হয়েছে হেফাজতকে। এর পেছনে সরকারের সঙ্গে আঁতাত, লেনদেন, ভেতরে ভেতরে ভাঙনসহ নানা কারণের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখন বিবৃতি ছাড়া হেফাজতের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না।
৫ মে রাতে শাপলা চত্বরের বহুল আলোচিত ঘটনার বার্ষিকীতেও নেই হেফাজতের বড় কোনো কর্মসূচি। কেন্দ্রীয়ভাবে হাটহাজারীতে স্থানীয় একটি স্কুলমাঠে ইসলামি সম্মেলন ও দোয়া অনুষ্ঠানে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর প্রধান অতিথি থাকার কথা রয়েছে। রাজধানীতে মহানগর হেফাজত বারিধারা মাদরাসায় ৫ মে আলোচনা ও দোয়ার আয়োজন করেছে। খেলাফত আন্দোলন শাপলা চত্বরে কালেমা খচিত পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দিলেও এর অনুমতি পায়নি বলে জানা গেছে।
গত বছরের ৫ মে পরর্বতী সময়ে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের কার্যকলাপ নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সরকারের সঙ্গে হেফাজতের ‘আঁতাত’কে সহজভাবে নিতে পারছেন না অনেকেই। সম্প্রতি হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফীর একটি বক্তব্যে সে ক্ষোভ আরো বেড়েছে। ‘আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ আমাদের শত্রু নয়’ এমন বক্তব্যে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। তারা মনে করেন, যে আওয়ামী লীগ শাপলা চত্বরের মতো ঘটনা ঘটাতে পেরেছে তারা আবার বন্ধু হবে কিভাবে!
সূত্র জানায়, হেফাজত এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত। মূলধারাটি হাটহাজারী মাদরাসাকেন্দ্রিক। আর রাজধানীতে হেফাজতের দুইটি ধারা-বারিধারা মাদরাসাকেন্দ্রিক একটি আর লালবাগ মাদরাসাকেন্দ্রিক একটি। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগও তেমন নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে তিন জায়গা থেকে হেফাজতের হয়ে তিন ধরনের বক্তব্য গণমাধ্যমে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোটের দুই নেতার জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে যোগদানকে কেন্দ্র করে ঢাকার হেফাজতের অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরো প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। হেফাজতের ঢাকার আহ্বায়ক আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমী জুনায়েদ আল হাবিব ও আব্দুর রব ইউসুফীকে নিজের দল জমিয়তে টেনে নেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে খেলাফত মজলিস ও ইসলামী ঐক্যজোট। এজন্য লালবাগ মাদরাসা এবং জামিয়া রাহমানিয়া হেফাজতে আর তেমন সক্রিয় নেই।
হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এই মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাচ্ছেন না। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার পাঁচ বছরের জন্য পুনরায় ক্ষমতায় বসে গেছে এজন্য তারা সরকারের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক বজায় রেখেই থাকতে চান। হেফাজতের ঘটনায় একাধিক মামলায় জড়িয়ে সব স্তরের নেতাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছে সরকার। কেউ একটু চাঙ্গা হতে চাইলে যেকোনো মামলায় গ্রেফতার করা হবে।
জানা যায়, সরকারও এই মুহূর্তে হেফাজতকে মাঠে দেখতে চায় না। এজন্য কিছুটা সমঝোতা, কিছুটা ভয় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোভ দেখিয়ে হেফাজতকে কাবু করে রাখতে চায় সরকার। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার এক্ষেত্রে অনেকটা সফল। হেফাজতকে নিয়ে এই মুহূর্তে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। অনেকে মনে করেন, হেফাজতকে ঠাণ্ডা রাখতেই গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকার। হাটহাজারী মাদরাসাকেন্দ্রিক হেফাজতের হাইকমান্ডের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ অব্যাহত আছে বলেও জানা যায়।
হেফাজতের এই নিষ্ক্রিয়তায় সবচেয়ে বেশি হতাশ মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, হেফাজত সারা দেশে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল তা ধরে রাখতে পারলে এদেশে ইসলামের পক্ষে বড় কাজ করা সম্ভব ছিল। হেফাজতের এই সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়ার জন্য তারা নেতাদেরকেই দায়ী করেন। হেফাজতের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে নানা অনিয়মের অভিযোগও ওঠেছে। বিশেষ করে মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা রুহী ও জুনায়েদ আল হাবীবের প্রতি হেফাজতের নেতাকর্মীরা বেশ ক্ষুব্ধ। শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থানের ব্যাপারে এই তিন নেতার ভূমিকাই প্রধান ছিল বলে অভিযোগ সাধারণ কর্মীদের। তাছাড়া ওই রাতের ঘটনার সময় এই তিন নেতার কেউই শাপলা চত্বরে ছিলেন না। এমনকি জুনায়েদ আল হাবিব ওই রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
হেফাজতের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হেফাজত নামক কোনো সংগঠন ছিল তা আমরা আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছি। আর কিছুদিন পর হেফাজত একটি থানাকেন্দ্রিক (হাটহাজারী) সংগঠন হিসেবেই হয়তো টিকে থাকবে। তিনি মনে করেন, হেফাজতের আমির বয়সের ভারে নুব্জ্য হয়ে পড়ায় তার আশপাশের লোকেরা হেফাজতের এই আন্দোলনকে ধ্বংস করেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আবেগকে পুঁজি করে কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বলেও অভিযোগ হেফাজতের কেন্দ্রীয় ওই নেতার।
হেফাজতের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়। পরে ওই মঞ্চে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে রাজীব নামে একজন সন্ত্রাসী আক্রমণে খুন হলে ব্লগে তার ইসলাম ও মহানবী সা.কে কটূক্তি করে লেখার বিষয়টি প্রকাশিত হয়। একইভাবে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো কয়েকজন ব্লগারের ইসলামবিদ্বেষী লেখার বিষয়েও খবর প্রকাশিত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে ইসলামি দল ও সংগঠনগুলো নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে বেফাকের সভাপতি ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম ৯ মার্চ হাটহাজারীতে উলামা সম্মেলন করে ১৩ দফা আন্দোলনের সূচনা করে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ শেষে রাজধানীর শাপলা চত্বরে ধর্মপ্রাণ মানুষের অংশগ্রহণে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশ থেকেই ৫ মে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল।
নানা বাধা প্রতিবন্ধকতার পরও হেফাজত ঢাকা অবরোধ করে। অবরোধ শেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার জন্য সমবেত হতে থাকে। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বায়তুল মোকাররম ও পল্টন এলাকায় সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষ বেধে যায়। অন্য দিকে শাপলা চত্বরে সমাবেশ চলতে থাকে। সন্ধ্যার আগেই বেশ কয়েকজন হেফাজতকর্মী মারা যান। সন্ধ্যায় হেফাজত শাপলা চত্বরে অবস্থানের ঘোষণা দিলে উত্তেজনা আরো ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে কমান্ডো স্টাইলে শাপলা চত্বরে অভিযান চালায়।
সকালের মধ্যে শাপলা চত্বর জনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে বহু লোক হতাহত হয় বলে হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করে। পরে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ৬১ জন নিহত হওয়ার কথা প্রকাশ করলে সংগঠনটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য পরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তাদের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনে ৫ মে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩৯ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। হেফাজত ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে এলেও এখন পর্যন্ত দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ ঘটনা তদন্তে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।