দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। সময় পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। ইতিমধ্যে তিনটি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো আর সাভারের হেমায়েতপুরে সরানো সম্ভব হয়নি।
শিল্পমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া সময়ে না সরায় ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। মালিকেরা আইনি নোটিশের জবাব দেওয়ার কথা বললেও এখনই না সরার ব্যাপারে অনড়। যদিও ট্যানারির মালিকেরা ইতিমধ্যে সাভারে ১৫৫টি প্লট, ক্ষতিপূরণের টাকা ও পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন। কিন্তু নানা অজুহাতে ট্যানারি সরানোর উদ্যোগ আটকে গেছে। এবারও একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম ট্যানারি না সরালে আইনি নোটিশ পাঠাতে। কিছু ট্যানারিকে পাঠানো হয়েছে, বাকিদেরও পাঠানো হবে।’ ১০ জানুয়ারি ট্যানারি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শিল্পমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে।
হাজারীবাগের ট্যানারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর। বলা হচ্ছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ এত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোনো দেশের প্রচলিত প্রযুক্তি দিয়েই এই নদীর পানি পরিশোধন সম্ভব নয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের একটি দল দুই বছর আগেই বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলেছিল, এই নদীর দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হাজারীবাগের ট্যানারি। ওই বিভাগের শিক্ষক ও পানি বিশেষজ্ঞ মো. মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পয়োবর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য বুড়িগঙ্গাকে যতটা না দূষিত করছে, তার চেয়ে আরও বেশি করছে ট্যানারির বর্জ্য। তাই ট্যানারি সরানো জরুরি।
২০০২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারের হেমায়েতপুরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে তা থেমে যায়। তবে ওই সময়ে একাধিক মামলার কারণে বাধা আসে বলেও জানা যায়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ট্যানারি সরানোসহ নদী রক্ষার পরিকল্পনা হয়। রিভার পল্যুশন মিটিগেশন কমিটি (আরপিএমসি) নামে একটি কমিটি বেশ কিছু সুপারিশও করে। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলের (২০০৯-১৪) শুরুতে নদীদূষণ ও অবৈধ জমি দখলসংক্রান্ত সংসদীয় উপকমিটি ২০১০ সালে অপর একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনায় হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প এলাকাকে সবচেয়ে দূষণকারী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দ্রুত সরানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি। ওই সময়ে স্থানান্তরের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আড়াই শ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। তবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদ্য বিদায়ী সভাপতি আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, এই টাকার মধ্যে মাত্র ৫০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এদিকে স্থানান্তরের জন্য অন্ততপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন বলে ট্যানারি সংগঠনগুলোর নেতারা দাবি করেছেন।
২৮ ট্যানারিকে নোটিশ: যেসব ট্যানারিকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে সেগুলো হলো চাঁদপুর ট্যানারি, ক্যাপিটাল ট্যানারি, আলেয়া ট্যানারি, আজিজ ট্যানারি, ভূঁইয়া ট্যানারি, সোনালি ট্যানারি, লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ, রুবি লেদার কমপ্লেক্স, ইউসুফ লেদার, ইউসুফ ট্যানারি, পাইওনিয়ার ট্যানারি, কমলা ট্যানারি, জিন্দাবাদ ট্যানারি, মুক্তি ট্যানারি, শাহী ট্যানারি, নজরুল ট্যানারি, রোশন কমপ্লেক্স, হেলেনা ট্যানারি, হোসেন ব্রাদার্স, ইব্রাহীম লেদার, ইন্টারন্যাশনাল ট্যানারি, কাদের লেদার, এইচএস ট্যানারি, গোল্ডেন লেদার, ঢাকা ট্যানারি, ডেলটা লেদার, সিটি লেদার ও চৌধুরী লেদার অ্যান্ড কোং।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নোটিশ যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জবাব দেবেন।
একাধিক মালিক অভিযোগ করেছেন, বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র (ইটিপি) না বসানোর কারণে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করার কথা ওঠে। এই যন্ত্র বসাতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন। তাঁদের দাবি, পরিশোধন যন্ত্র বসাতে যে অর্থের প্রয়োজন, সেই অর্থে বর্তমান স্থানেই যন্ত্র বসানো যেত। তা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
হাজারীবাগে আড়াই শ ট্যানারির মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে হেমায়েতপুরে মাত্র ১৫৫টি কারখানা স্থাপনের প্লট দেওয়া হয় বলেও মন্তব্য করেন একাধিক মালিক। এর ফলে যাঁরা সেখানে প্লট পাননি, তাঁরা হাজারীবাগ ছেড়ে যেতে চাইবেন কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাজারীবাগের প্রায় এক লাখ শ্রমিকের বাসস্থান হেমায়েতপুরে কোথায় হবে, তা এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। যে প্লটগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো সর্বোচ্চ ৩৬ লাখ এবং সর্বনিম্ন ১৬ লাখ বর্গফুটের। মালিকদের কাছ থেকে ইটিপির খরচ নিয়ে এগুলো বিক্রি করা হয়েছে।
বসবাসের অনুপযোগী: গত মঙ্গলবার সরেজমিনে এলাকায় দেখা যায়, স্থানীয় কালুনগর, জেলেপাড়া, ভাগলপুর, মনেশ্বর রোড, টালি অফিসসহ হাজারীবাগের প্রায় সব এলাকাই বর্তমানে বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে গেছে। একদিকে ট্যানারির লাল ও কালো পানিতে সয়লাব হয়ে থাকে এলাকার রাস্তাঘাট, অন্যদিকে দুর্গন্ধ। দেখা যায়, কালুনগর এলাকায় জলাশয় থেকে নর্দমা—সর্বত্রই ট্যানারির লাল পানি। সেখানকার বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুস বলেন, তাঁর পরিবারে পাঁচজন সদস্য সব সময়ই চর্মরোগে ভোগেন। আত্মীয়স্বজনও বেড়াতে আসতে চায় না।
ভাগলপুর এলাকার বাসিন্দা শাহীন সিদ্দিকী বলেন, পৈতৃক জায়গা ছিল, কিন্তু নিজের থাকার জন্য বাড়ি করেও থাকতে পারেননি। দোকান করার জন্য আসেন। ঘর ভাড়া দিয়েছেন, কিন্তু রাজধানীর অন্য এলাকায় যেখানে ছয় মাস পরপর ভাড়া বাড়ে, এই এলাকায় ভাড়া কমে। সব সময়ই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। মনেশ্বর রোডের বাসিন্দা মনিহারি দোকানের মালিক মইনুল হোসেন তাঁর দোকানে প্রসাধনসামগ্রী রাখতে ভরসা পান না। বলেন, ঘরের চালের টিন বিবর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি, নতুন স্টিলের আলমারিও এক মাসের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। অপর এক দোকানি বলেন, শুধু আলমারি নয়, ভেতরে রাখা সোনার গয়নার রং পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে।
শুধু ওই এলাকা নয়, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পোস্তা এলাকায়ও দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, জলাশয় ভরাট হয়ে পড়ায় এলাকায় ট্যানারির পানি আসে না। কিন্তু গন্ধ ভেসে বেড়ায়। তিনি বলেন, আগে মানুষ বুঝতে পারত না যে, এই ট্যানারির কারণে তাঁরা একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখন মানুষ সচেতন। তাঁরা চান ট্যানারি সরে যাক।
Next Post