৩৬৫ দিন পর

0

রমজান শুরু হতে আর এক বা দুইদিন বাকি। প্রতি বছরই রমজান মাস এলেই দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। এবার এক ভিন্ন পরিস্থিতি বাজারে। পণ্যের দাম শুধু বাড়েনি। কোনো কোনো পণ্যের দাম আগের রমজানের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। দাম বাড়েনি এমন কোনো পণ্য নেই বাজারে। এমন অবস্থায় আসছে রমজানে সাধারণ মানুষকে বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হবে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে। নিত্যপণ্যগুলোর মধ্যে চাল, ডাল, খেজুর, আটা, তেল, চিনি, পিয়াজ, মসলা ও বিভিন্ন সবজির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বছরের ব্যবধানে এসব পণ্যে দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়তে দেখা গেছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি’র প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে অন্য বছর রোজার আগে বাজার থাকতো জমজমাট। পণ্য কেনার হিড়িক পড়তো। তবে এবার ক্রেতাসংখ্যা কম লক্ষ্য করা গেছে। আর দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা ক্রেতাও এখন কম পরিমাণে পণ্য কিনছেন। বিক্রেতারা বলেন, বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। সবকিছুর দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা তেমন একটা কেনাকাটা করছেন না।

কাওরান বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজান সামনে গত বছরের তুলনায় তাদের এবারের বিক্রিতে ব্যাপক পতন ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি আগে কখনো ঘটতে দেখা যায়নি দেশে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সবকিছুর দাম বাড়ায় এমনিতেই সাধারণ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বেড়েছে। জমানো সঞ্চয় ভেঙে, ধার-দেনা ও ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে কোনো পণ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চরম অস্বস্তিতে মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষরা। রমজান মাসে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এ আস্থা মানুষের মধ্যে নেই।

গত এক বছরের নিত্যপণ্যের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে নতুন করে দাম বেড়েছে- চিনি, আটা-ময়দা, চাল, ভোজ্য তেল, ডাল, ছোলা, খেজুর, ডিম ও ব্রয়লার মুরগি, মাছ-মাংসসহ ইফতার ও সেহরিতে ব্যবহৃত নিত্যপণ্যের দর।

গত রোববার বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রোজার প্রথমদিকে অধিক হারে কেনাকাটা করে মুজত করেন ভোক্তারা। এতে অনেক সময় সাময়িক দাম বেড়ে যায়। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমাদের যা প্রয়োজন তার মিনিমাম দেড়গুণ তাদের কাছে মজুত রয়েছে ও পাইপলাইনে আছে। ফলে কোনোভাবেই কোনো সমস্যা হবে না। রোজায় এবার অধিকাংশ ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তবে এরপরেও কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যে থাকবে না, সেই নিশ্চিয়তা দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বসে থাকবে না।

গত বছরের রমজানের আগে এপ্রিল মাসে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আর বর্তমানের তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা গেছে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ৫১ শতাংশ, আটার দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ আর চিনির দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। শুধু তাই নয়, রমজানে যেসব পণ্য বেশি কেনা হয়, যেমন- ছোলা, ভোজ্য তেল, ডাল, খেজুর, আদা ও রসুন এসব পণ্যের দামও গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে।

সয়াবিন তেল: টিসিবি’র হিসাবে, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮৫ টাকায়, যা গত বছর এ সময়ে ছিল ১৪৫ থেকে ১৫৪ টাকা।

ছোলা-ডাল: বাজারে প্রতি কেজি ছোলা ৮৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর এ সময়ে ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ ছাড়া বুটের ডাল-অ্যাংকর-পিয়াজুর ডাল বা মোটা ডালের কেজি ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে। এদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারে দেশি ভালো জাতের ছোলা ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

চিনি: বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়। গত বছর ছিল ৮০ টাকা। বাজারে প্যাকেটজাত চিনি নেই বললেই চলে।

মাংসের দাম: বাজার ভেদে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৬০ টাকা দরে। গত বছর ছিল ১৫০ টাকা। পাশাপাশি বর্তমানে গরুর মাংসও প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায়। গত বছর ছিল ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। আর খাসির মাংস প্রতি কেজি ৯৫০ থেকে ১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খেজুর: বর্তমানে বাজারে সাধারণ মানের প্রতি কেজি খেজুরের দাম ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা, যা গত বছর সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছিল ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়।

চাল: বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, যা গত বছর এ সময়ে ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। মাঝারি মানের চালের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬২ টাকা। আর সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। আর এক কেজি প্যাকেটের পোলাও এর চাল ১৭০ টাকায় ঠেকেছে। এ ছাড়া আটা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। আর গত বছর ছিল ৩৫ টাকায়।ডিম: গত বছর ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। বর্তমানে ১৩৫ টাকয় ঠেকেছে।

মাছ: গত বছর রুই মাছের কেজি ছিল ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকায়। তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। বর্তমানে সেখানে এখন রুই মাছের কেজি (আকার ভেদে) ৩০০-৫০০ টাকায়।

বেসরকারি চাকরিজীবী নোমান সরকার বলেন, সব পণ্যের দামই বাড়তি। আগে একসঙ্গে কয়েক দিনের বাজার করতাম। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিনছি কাটছাঁট করে। যেমন; আগে একেবারে দুই কেজি ছোলা নিতেন। এবার কিনলেন আধা কেজি। ৫৫-৬০ টাকার চিনি এখন ১২০ টাকা হয়েছে। এই টাকায় আগে ডাবল বাজার করা যেতো।

এদিকে বিক্রেতারা জানান, যারা আগে ৫ কিংবা ১০ কেজি করে চাল, ডাল কিংবা ছোলা কিনতেন, তারা এখন কিনছেন ১ বা ২ কেজি। কাস্টমার আগের চেয়ে কমে গেছে। পরিমাণে কম কিনছেন।

মুদি দোকানি ফাইজুল বলেন, দোকানে বেচাকেনা খুবই কম। রোজার আগে যেভাবে এতদিন মার্কেট জমে উঠতো, সেভাবে এখন আর জমছে না। অনেক ক্রেতা দাম-দর জিজ্ঞেস করছেন কিন্তু দাম শুনে ফিরে যাচ্ছেন।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি শামসুল আলম বলেন, সরকার জনগণকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে ভোক্তার অধিকার রক্ষার বিষয় সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে কোন পণ্যের মজুদ কতো?: দেশে ভোজ্য তেলের (সয়াবিন, পাম ও সরিষা) বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন, স্থানীয় উৎপাদন ২ লাখ ৩ হাজার টন। বছরে ২০ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেল আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টন থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টন ভোজ্য তেলের চাহিদা থাকলেও রোজায় তা দ্বিগুণ বেড়ে ৩ লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়।

এদিকে দেশে বছরে ২০ লাখ টন চিনির চাহিদার বিপরীতে দেশের আখ থেকে আসে ৩০ হাজার টন। প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়। বর্তমানে চিনির মজুত আছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৬৩ টন, পাইপলাইনে আছে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ টন।

এ ছাড়া দেশে মসুর ডালের চাহিদা আছে ৬ লাখ টন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ ২০ হাজার টন, আমদানি হয় প্রায় ৪ লাখ টন। মাসিক চাহিদা ৪০ হাজার টন হলেও রোজার মাসে চাহিদা ১ লাখ টন।

এ ছাড়া দেশে পিয়াজের চাহিদা বছরে ২৫ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২৭ লাখ টন। সেখান থেকে ২৫ শতাংশ বার্ষিক সংরক্ষণজনিত ক্ষতি বিবেচনা করা হয়। প্রতি মাসে ২ লাখ টন পিয়াজের চাহিদা থাকলেও রোজার মাসে তা ৪ লাখ টন ধরা হচ্ছে।

ছোলার বার্ষিক চাহিদা দেড় লাখ টন, এর মধ্যে কেবল রোজার মাসেই ১ লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন করে ছোলা আমদানি হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে বছরে প্রায় ৫ হাজার টন ছোলা উৎপাদন হয়।

খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ১ লাখ টন, এর মধ্যে রোজার মাসে চাহিদা ৫০ হাজার টন।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৩৫ লাখ ডিম উৎপাদন হয়েছিল। জনপ্রতি ১০৪টি ডিমের চাহিদা বিবেচনায় ডিমের বার্ষিক চাহিদা ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ৬৮ লাখ।

বছরে মুরগির মাংসের চাহিদা ৪০ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ১৮ লাখ মুরগি উৎপাদন হয়েছে।

উৎসঃ   মানবজমিন
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More