ঢাকা: বিভিন্ন ফল, সবজি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এবং শুঁটকি মাছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর বেশ কিছু নিষিদ্ধ সার ও কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমেরিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের একটি সরকারি গবেষণাগারে অনুষ্ঠিত এক গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণা পরিষদের (এনএফএসএল) এই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে- ইউরোপীয় ইউনিয়ন খাদ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকার যে সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে, গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা খাদ্যগুলোতে তার চাইতে তিন থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে।
গবেষণায় ব্যবহৃত ৮২টি নমুনা খাদ্যের মধ্যে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই এমন সব কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যেগুলো প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে থেকে এদেশে নিষিদ্ধ। উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়ায় এই কীটনাশকগুলো ফসলে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এসব নিষিদ্ধ কীটনাশকের মধ্যে আছে ডিডিটি (ডাইক্লোরো-ডাইফেনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন), অলড্রিন, ক্লোডেন এবং হেপ্টাক্লোরসহ আরো বিভিন্ন উপাদান যেগুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
গাজর, শিম, টমেটো, লেটুস পাতা, ক্যাপসিকাম, কলা, আপেল, আনারস এবং আমসহ বিভিন্ন ফল সবজিতে এসব উচ্চমাত্রার বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া দুধে পাওয়া গেছে আরেকটি নিষিদ্ধ কীটনাশক অলড্রিনের উপস্থিতি। এনএফএসএল’র গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
খাদ্যে এসব নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহারের যে চিত্র উঠে এসেছে, তার জন্য মাঠ পর্যায়ে সরকারের পর্যবেক্ষণের অভাবকেই দায়ী করেছেন বেশ কয়েকজন কৃষিবিদ। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী- যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চমাত্রার এসব বিষাক্ত উপাদান আমদানি করা নিষিদ্ধি, সম্ভবত এসব কীটনাশক বাইরের দেশ থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে।
গবেষণায় নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত সবজির মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ফলের মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশতেই ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে, এই উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়।
শুধু যে মানবস্বাস্থ্যের জন্যই এই কীটনাশকগুলো ক্ষতিকর তাই নয়, প্রাণীদেহেও এগুলো বিষের মতো কাজ করে- জানিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের এফএও’র আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিযুক্ত খাদ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা শ্রীধর ধর্মপুরি জানান, মানবদেহে এই উপাদানগুলো দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকলে তা মারণব্যাধি ক্যানসারের কারণ হতে পারে এবং প্রজনন ও স্নায়বিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরো জানান, ভারী ধাতব রাসায়নিক পদার্থ যেমন সীসা, ক্রোমিয়াম এবং আর্সেনিকের মতো পদার্থগুলো মানবদেহে প্রবেশ করার পর জমতে থাকে এবং একসময় এই উপাদানের কারণে দেহে কিডনি ও যকৃত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। খাদ্যে ব্যবহৃত এসব উপাদানের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) পতঙ্গবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল আলম বলেন, “আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হলো, আমাদের দৈনন্দিন খাবারগুলোতেও এই বিষাক্ত কীটনাশকগুলো পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এসব কীটনাশকে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি থাকার কারণে অনেক বছর আগেই এগুলো এদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।”
গত বছর বিএআরআই’র এক গবেষণাতেও শুঁটকি মাছে এসব নিষিদ্ধ কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল বলেও জানান তিনি।
কৃষিখাতে এসব কীটনাশকের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (ডিএই) উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার ওপরে। কীটনাশক এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ এবং পরিদর্শকও রয়েছেন।
ডিএই’র মহাপরিচালক মো. আবু হানিফ মিয়া জানান, নিষিদ্ধ এবং নিম্নমানের কীটনাশকের কেনা-বেচা ও ব্যবহার ঠেকাতে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।
অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের কেনা-বেচা নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, “দোকানে আপনি এসব নিষিদ্ধ কীটনাশক খুঁজে পাবেন না।”
তাহলে ফল ও সবজিতে এসব কীটনাশক কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে জানতে চাইলে এক প্রশ্নের জবাবে এই উপাদানগুলোর দেশের পাচার হয়ে আসার সম্ভাবনার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশ ফসল সংরক্ষণ সংস্থার (বিসিপিএ) চেয়ারম্যান রুমান হাফিজ দাবি করেন, দেশে এসব নিষিদ্ধ কীটনাশক আমদানি ও বিক্রয়ের কোনো সুযোগ নেই বলে তার সংস্থার কোনো সদস্য কোনোভাবেই এসব নিষিদ্ধ কীটনাশক কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত নন।
সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে এসব কীটনাশকের এদেশে প্রবেশ করার সম্ভাবনার কথা জানান বাংলাদেশে কীটনাশকের বাজার তৈরি করে দেয়া প্রতিষ্ঠান বিসিপিএ’র এই নেতা। তিনি বলেন, “দেশে এই ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক উপাদানের বাণিজ্য বন্ধ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর।”
ফল ও সবজি ছাড়াও গবেষণাতে নমুনা হিসেবে এনএফএসএল চাল, হলুদ, পোল্ট্রির বিভিন্ন প্রাণীর মাংস এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত জুস বা শরবতও পরীক্ষা করেছে এনএফএসএল। এসব খাবারে ভারী রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি তুলামূলক কম পাওয়া গেছে গবেষণায়।
গবেষণায় বলা হয়, ১৩টি নমুনা খাবারের মধ্যে তিনটি খাবারে আর্সেনিক ও ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে নিরাপদ সীমা ছাড়িয়ে। আর ধনে পাতা, আম এবং চিংড়িতে পাওয়া গেছে ফরমালিন।
কিছুদিন আগে এক গবেষণায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এবং টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে হলুদে।
মুরগী এবং মাছের নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিও পেয়েছে এনএফএসএল। গবেষণায় বলা হয়, “পাস্তুরিত দুধের বেশ কয়েকটি নমুনায় উচ্চহারে জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা উৎপাদকদের নিম্নমানের প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিকেই নির্দেশ করে।”
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সুবিমল সিনহা চৌধুরী জানান, যখন থেকে খাদ্যশৃঙ্খলে রাসায়নিক ও ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যেতে শুরু করেছে, তখন থেকে মাছ ও গৃহপালিত প্রাণীর খাবারে যেসব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক হওয়াকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে নেয়া উচিত ছিল। এসব ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই খাবারে প্রবেশ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অবিলম্বে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বাধ্যবাধকতা ও নির্দেশনা উল্লেখ করে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার।”
সরকারি সংস্থাগুলোর আগ্রহ ও উদ্যোগের অভাবে খাদ্যে ভেজাল সংক্রান্ত যেসব প্রতিবেদনগুলো এতদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার উঠে আসছিল, সেসব তথ্যকেই সঠিক প্রমাণিত করল এনএফএসএল।
এসব গবেষণার ফল সম্পর্কে মহামারী ও রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, “আসল সমস্যা আরো অনেক বড়।”
খাবারে ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক এবং সীসার মতো এসব ভারী ধাতব রাসায়নিকের উপস্থিতি ক্যানসারের কারণ হতে পারে এবং অচল করে দিতে পারে যকৃত ও কিডনি, জানান মাহমুদুর রহমান।
খাবারে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাবারে এসব বিষাক্ত উপাদান উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রবেশ করানো হচ্ছে, আর পুরো ঘটনাটি এমনভাবে ঘটছে যা বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়ার উপায় নেই। এই বিষয়টি আসলেই খুব বড় সমস্যা।”
খাদ্যে ভেজালের জন্য দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করার ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, “এই গবেষণার আওতায় আরো অনেক খাদ্য আনা যেত, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্যে ভেজাল রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা।”
খাদ্যে ভেজাল এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার রোধ করতে হলে সরকারকে অবিলম্বে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশাসন গঠন করতে হবে বলেও জানান তিনি।
খাদ্যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গত বছরের নভেম্বর মাসে একটি খসড়া খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ হিসেবে একজন চেয়ারম্যান এবং চারজন সদস্য নিয়োগ দেয়ার জন্য চলতি মাসের শুরুতেই লোকপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্যসচিব মুশফেকা ইকফাত বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব এসব ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা।”
তিনি জানান, মতামত যাচাইয়ের জন্য এরই মধ্যে খসড়া আইনের কপি ১৩টি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে এবং তারপর খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করে নিরীক্ষণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইনটি চূড়ান্ত করতে তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান ইকফাত।
[ইংরেজি দৈনিক ডেইল স্টার থেকে প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন-নুজহাত কামাল]