সূর্যবান বিবি কাউকে দেখলেই এগিয়ে যান । জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদেন, ছেলের খবর জানতে চান। তবে তাঁর চোখ এখন আর সজল হয় না। কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে অশ্রু।
তিন বছর ধরে অনবরত কেঁদে চলেছেন ছেলে ইলিয়াস আলীর জন্য। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী।
নিখোঁজের ৪৪ মাস আজ। আজো তার নিখোঁজের রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস, এখনো বেঁচে আছেন ইলিয়াস আলী।
যেকোনো সময় তিনি ফিরে আসবেন। এ জন্য টেলিভিশন চালু করলেই তারা চেয়ে থাকে পর্দার নিচের অংশে, যেখান দিয়ে একটার পর একটা খবরের শিরোনাম বয়ে চলে।
পুরো পরিবার অপেক্ষা করছে সেই দিনের জন্য, যেদিন টিভিগুলো ব্রেকিং নিউজ দেখাবে যে ‘ইলিয়াস আলীর সন্ধান পাওয়া গেছে’।
শুধু পরিবারের সদস্যরা নয়, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর জন্মভূমি বিশ্বনাথ তথা সিলেটের লাখো মানুষও একই অপেক্ষায় দিন গুনছে।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে নিজের গাড়িতে করে বনানী থেকে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন ইলিয়াস আলী। তাঁর সঙ্গে গাড়ি চালক আনসার আলীও নিখোঁজ হন।
মহাখালী থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাঁর গাড়ি। নিখোঁজ হবার পর ইলিয়াস আলীর পরিবারে ভর করে দীর্ঘশ্বাসের কালোমেঘ।
নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অজানা আশঙ্কায় রয়েছেন তাঁর নিজ উপজেলা বিশ্বনাথের মানুষ।
সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক ইলিয়াস আলীর গর্ভধারিনী বৃদ্ধা মা সূর্যবান বিবি। তিনি পুত্র শোকে কাতর। অনেকটা শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি অপেক্ষার প্রহর গুণছেন পুত্রের জন্য। স্বামীর খোঁজে দিশেহারা ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদি লুনা।
পিতাকে ফিরে পাবার আশায় বুকে পাথর বেঁধে দিন যাপন করছে ইলিয়াসের পুত্র আবরার ইলিয়াস, লাবিব সারার ও মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল।
পরিবারের একটাই দাবি তারা যে কোন মূল্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক আনসার আলীকে অক্ষত এবং সুস্থ অবস্থায় তাদের মাঝে ফিরে পেতে চান।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। পালিত হয় হরতাল, মিছিল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহসহ নানা কর্মসূচি।
২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল হরতাল পালনের সময় সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় জনতার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়।
পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বিএনপির তিন কর্মী। আহত হয় শতাধিক। ঘটনার পর উপজেলার অজ্ঞাত পরিচয় আট হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। কারাবরণ করেন প্রায় দুই শতাধিক নেতা-কর্মী।
ইলিয়াস নিখোঁজের প্রতিবাদে ও তাঁর সন্ধানের দাবিতে সিলেট একসময় উত্তাল হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আন্দোলন থিতু হয়ে এসেছে।
এখন উপাসনালয়ে প্রার্থনা ছাড়া এ ইস্যুতে বিএনপির কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর তাঁর মা সূর্যবান বিবি ও পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিতে বিশ্বনাথের রামধানা গ্রামের বাড়িতে ঢল নামত নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের।
সময়ের ব্যবধানে সেই দৃশ্যও এখন বদলে গেছে। এখন আর কাতর মাকে সান্তনা দিতে নেতা-কর্মীরা সেভাবে ওই বাড়িতে যায় না। ওই পরিবারের খোঁজখবরও আগের মতো নেয় না নেতা-কর্মীরা।
তবে এখনো আশা ছাড়েনি ইলিয়াস পরিবার। ছেলে ফিরে আসবে-এ আশায় বুক বেঁধে আছেন মা। স্বামীকে ফিরে পাওয়া যাবে-এ আশায় দিন পার করছেন স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা।
আর বাবার ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে তিন সন্তান-সাইয়ারা নাওয়াল, আবরার ইলিয়াস ও লাবিব সারা।
তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘যখনই টেলিভিশনের সামনে বসি সংবাদের স্ক্রলের দিকে চেয়ে থাকি। একটা ব্রেকিং নিউজের জন্য অপেক্ষা করি,যেখানে লেখা থাকবে ‘ইলিয়াস আলীকে পাওয়া গেছে’।
আমরা প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর ফেরার অপেক্ষায় আছি। আমাদের বিশ্বাস, তিনি বেঁচে আছেন এবং অবশ্যই ফিরে আসবেন।
তাকে ফিরে পেতে দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন তিনি।