জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে আগামীকাল বৃহস্পতিবার এবং রোববার হরতালের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
একইসঙ্গে আগামী শুক্রবার এবং শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে দলটি। বুধবার সকাল ১০টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংক্ষিপ্তভাবে এ রায় দেন। এর পরই জামায়াতে ইসলামী হরতালের এ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এদিকে, আল্লামা সাঈদীকে সরকারের সাজানো, মিথ্যা মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদানের প্রতিবাদ এবং এই মুহূর্তে তার মুক্তির দাবি জানিয়ে দলটি। বুধবার এক যুক্ত বিবৃতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা:শফিকুর রহমান এ প্রতিবাদ জানান। একই সঙ্গে তারা বৃহস্পতিবার ও রোববার হরতাল এবং শুক্রবার দোয়া ও শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ ৪ দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
বিবৃতিতে জামায়াত নেতারা বলেন, ‘মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন আলেমে দ্বীন, বিশ্ববরেণ্য মোফাসসিরে কুরআন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অগণিত মানুষের হৃদয়ে তার স্থান। বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল যাবৎ তিনি দেশে-বিদেশে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর পেশ করে আসছেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তার কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি কুরআনের ময়দানে বিচরণ করেছেন সদা-সর্বদা।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ শে জুন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা, কাল্পনিক ও বায়বীয় অভিযোগে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে।
সরকার এ মামলায় তাঁকে ফাঁসানোর জন্য নানান ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। বেলজিয়াম থেকে পাঠানো জনৈক জিয়াউদ্দীনের পাঠানো চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারের উপর ভিত্তি করে চার্জ গঠন করা হয়। ধান চোর, কলা চোর, ট্রলার চোর, যৌতুক আইনে দন্ডপ্রাপ্ত ও বিভিন্নভাবে সরকারী সুযোগ সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করে সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৬ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির না করে তাদের জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক নজিরবীহিন ঘটনা।
সরকার পক্ষের সাক্ষীদের সেইফ হাউসে রেখে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়। আল্লামা সাঈদীর বক্তব্য না শুনেই তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানী অন্যায়ভাবে সমাপ্ত করা হয়। সরকার ইচ্ছা মাফিক সাক্ষী প্রদান করলেও সাঈদী সাহেবের পক্ষের সাক্ষীর সংখ্যা সীমিত করা হয়। দেলু শিকদার নামক কুখ্যাত রাজাকারের অপকর্মের দায় সাঈদী সাহেবের উপর চাপানো হয়। সাঈদী সাহেবের পক্ষের সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করে ভারতে পাচার করা হয়।
স্কাইপ কেলেংকারীর পর সংশ্লিষ্ট বিচারক পদত্যাগ করলেও তার রেকর্ড করা জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করে ট্রাইব্যুনালে রায় প্রদান করা হয় বলেও বিবৃতিতে বলা হয়। ১৯৭২ সালে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলা ও চার্জশীটের সার্টিফাইড কপি আদালতে জমা দেয়ার পরেও তা আমলে নেয়া হয়নি। এভাবে মাওলানা সাঈদীকে প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডারসহ অনেক সাক্ষী এবং ১৯৭১ সালে কথিত ঘটনার সময় সাঈদী সাহেব যশোরে অবস্থান করেছেন মর্মে বেশ কয়েকজন সাক্ষী সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষী দেয়ার পর মাওলানা সাঈদীকে ১ ঘন্টার সাজা প্রদানেরও যেখানে সুযোগ নেই সেখানে বিগত ৫১ মাস যাবৎ তাকে সরকার অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক রেখেছে। বন্দী অবস্থায় তিনি হারিয়েছেন মমতাময়ী মাকে, হারিয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যাকে কুরআনের মুফাস্সির হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সেই রাফিক বিন সাঈদীকে। মা ও সন্তান হারানোর বেদনায় যখন তিনি শোকাহত তখন তাকে পরিবার ও আপনজনের কাছে উপস্থিত হয়ে শোক নিবারণের ন্যূনতম সুযোগও দেয়া হয়নি। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশ পাঠানোর জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো সত্ত্বেও তাঁকে চিকিৎসার কোন সুযোগ দেয়া হয়নি।
বারবার তিনি এ সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলায় আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও তিনি ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়ে চরম জুলুমের শিকার হলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তাঁকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়ে ন্যায় বিচার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ রায় বহাল থাকলে কোটি কোটি জনতার প্রাণপ্রিয় এ মানুষটিকে জেলের ভিতরেই ইন্তেকাল করতে হবে। একজন নিরপরাধ মানুষের ক্ষেত্রে কোনভাবেই এটাকে মেনে নেয়া যায় না। তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দায়ের করবেন। আশা করি তিনি সেখানে ন্যায় বিচার পাবেন এবং আবারও কুরআনের ময়দানে ফিরে আসবেন, ইনশাআল্লাহ।
দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতা আল্লামা সাঈদীর উপর সরকারের এ জুলুম কিছুতেই মেনে নেবে না। সরকারের এ জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং তার এই মুহূর্তে মুক্তির দাবীতে আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত কর্মসূচি ঘোষণা করছি-
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টার হরতাল।
১৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সরকারের জুলুম থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশে-বিদেশে আল্লামা সাঈদীর জন্য দোয়া অনুষ্ঠান। ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ। ২১ সেপ্টেম্বর রোববার ভোর ৬টা থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টার হরতাল।
উপরোক্ত কর্মসূচীসমূহ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে পালনের জন্য দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, ছাত্র, শিক্ষক, ধর্মপ্রাণ মুসলমান, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আমরা উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
এ অবৈধ সরকার তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে দলীয় বাহিনীর দ্বারা সন্ত্রাস সৃষ্টি ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর পরিকল্পিত হামলা এবং উস্কানী দিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছে।
জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের সকল প্রকার উস্কানী চরম ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা ও সকল ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য জামায়াতের সর্বস্তরের কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খী ও দেশপ্রেমিক জনতার প্রতি আমরা আহবান জানাচ্ছি।
অবিলম্বে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উপর জুলুম বন্ধ করে এই মুহূর্তে আমরা তাঁর মুক্তি দাবী করছি।’