জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি বন্ধ

0

jamat_flag2_eমুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলা করা এবং তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে৷ এ কারণে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দািখলের পর প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও দলটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা যায়নি। সর্বশেষ গতকাল সোমবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরির কাজই বন্ধ হয়ে গেছে৷
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রধান সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানকে (এম খলিলুর রহমান) গতকাল অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে৷
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় এম কে রহমান আর ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না৷ তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অব্যাহতি দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি৷’
রাষ্ট্রপক্ষের নেতৃত্ব নিয়ে প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গে এম কে রহমানের আগে থেকেই বনিবনা হচ্ছিল না৷
রাষ্ট্রপক্ষের সূত্র জানায়, সৈয়দ হায়দার আলী রাষ্ট্রপক্ষের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলি হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলিদের মধ্যে দুটি পক্ষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ১৫ মে জামায়াতের বিষয়ে তদন্তের সব নথিপত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলির কাছে হস্তান্তরের নোটিশ দেওয়া হয়। আর এই মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত কৌঁসুলিদের দলটি গতকাল থেকে অভিযোগ তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয়৷ তারা এ বিষয়ে প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর জরুির সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা চেয়ে তাঁর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। ১৩ মে প্রধান কৌঁসুলির এক মাসের ছুটি শেষ হলেও গতকাল পর্যন্ত তাঁকে দপ্তরে পাওয়া যায়নি৷ তবে তিনি দেশে আছেন বলে জানা গেছে৷
রাষ্ট্রপক্ষের সূত্রগুলো জানায়, ১৫ মে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হৃষিকেশ সাহা প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে একটি নোটিশ জারি করেন। নোটিশে বলা হয়, জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রপক্ষের জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলিরা ওই নথিপত্র পরীক্ষা করতে পারেন।
মামলা পরিচালনাকারী দলের সাত সদস্য হলেন: তুরিন আফরোজ (সমন্বয়ক), রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ-আল-মালুম, সুলতান মাহ্মুদ, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলি ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদার।
একাধিক সূত্র জানায়, ১১ মে বিকেলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভায় অবশ্য জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি দলের সাত সদস্যের পাঁচজনই উপস্থিত ছিলেন না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল বিকেল পাঁচটায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জরুির আলোচনায় আছেন, পরে কথা বলবেন। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা ও রাত পৌনে আটটায় তাঁকে আবার ফোন করা হয়৷ তিনি ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে জামায়াতের মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত কৌঁসুলি দলের সমন্বয়ক তুরিন আফরোজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াতের মামলার সব নথিপত্র হস্তান্তরের জন্য যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা অনভিপ্রেত। তার পরও নোটিশের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা মামলাসংক্রান্ত সব কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছি। তবে মামলার নথিপত্র প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে। তাই তিনি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এগুলো ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলিকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়।’
গতকাল প্রধান কৌঁসুলিকে পাঠানো তুরিন আফরোজের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, জামায়াতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মামলার সমন্বয় ও গবেষণা তুরিন আফরোজ করবেন। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাত ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে গত ২৫ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে ৩৭৩ পৃষ্ঠার মূল তদন্ত প্রতিবেদনসহ নয় হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র চূড়ান্ত করে তদন্ত সংস্থা। ২৭ মার্চ ওই প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। ওই দিন প্রধান কৌঁসুলি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কৌঁসুলি দল তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করবে। তারপর সেটি ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য দাখিল করা হবে। মামলায় জামায়াতের কী শাস্তি চাওয়া হবে, জানতে চাইলে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘তদন্ত সংস্থা দলটি নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে৷ আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব, নিষিদ্ধের শাস্তি, নাকি সম্পদ বাজেয়াপ্ত, নাকি উভয় শাস্তিই চাইব৷’
ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে গত বছরের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট৷ এ রায়ের বিরুদ্ধে দলটির পক্ষে সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল করেন, যা শুনানির অপেক্ষায় আছে৷
গত কয়েক মাসে নানা বিষয়ে বারবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায়৷ গত মার্চে তুরিন আফরোজসহ রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক কৌঁসুলিকে নিয়ে গণমাধ্যমে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করেন আরেক কেঁৗসুলি মোহাম্মদ আলী। তুরিন আফরোজ এ নিয়ে প্রধান কৌঁসুলির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন৷ ওই সংকট কাটতে না-কাটতেই রাষ্ট্রপক্ষের নেতৃত্ব নিয়ে প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু ও প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা ঘটছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্রপক্ষের এসব কাজে যদি মানুষের মনে হয়, জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে সরকার ছাড় দিচ্ছে, তবে তা সাংঘাতিক উদ্বেগের বিষয়।’ তিনি বলেন, পুরো রাষ্ট্রপক্ষকে ঢেলে সাজাতে হবে; অদক্ষ, অযোগ্য ও দেশপ্রেমহীন কৌঁসুলিদের বাদ দিতে হবে। যদি জামায়াতের মামলা নিয়ে কোনো রকমের ত্রুটি হয়, এর দায় সরকারকে নিতে হবে।

সূত্র : প্রথম আলো

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More