নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকা, সরকারি দলের সঙ্গে সুসম্পর্কসহ নানান কারণে সাংগঠনিক বিপর্যয়ে পড়েছে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। সদ্য অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থিত প্রার্থীদের চরম ভরাডুবির মধ্যদিয়ে তা ফুটে উঠেছে।
জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার জানান, সদ্য অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল পার্টির কোনো নেতা-কর্মীর কাক্সিক্ষত নয়। এই ফলাফল উপলব্ধি করে আমাদের আগামীতে সাংগঠনিক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোটভাই ও প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মুহম্মদ কাদের জানান, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। রাজনীতির মতো জাতীয় পার্টিও ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দলের শক্তি ও সৌন্দর্য হলো জনসমর্থন। বর্তমানে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন প্রায় তলানির কোটায়। এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির কোনো নিজস্ব রাজনীতি নেই। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বলা হচ্ছে। তবে বিরোধী দলের রাজনীতি তো নয়ই, সরকারি দলের বাইরে আলাদা কোনো রাজনৈতিক সত্তা বা বৈশিষ্ট্য জাতীয় পার্টির আছে বলে মনে হয় না। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ জানান, রাজধানী যার গোটা দেশ তার। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা কতটা ভালো তার মূল্যায়ন সিটি নির্বাচনের ফল। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজধানীবাসী আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে সংগঠনের চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, সংগঠন হিসেবে ইতিহাসে জাতীয় পার্টির অবস্থান কোথায় হবে খুব শিগগিরই আমরা হয়তো দেখতে পাব। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। জানা যায়, পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ রাজধানীতে সভা-সমাবেশ বা বৈঠক ডাকলে দলের ৩৪ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে উপস্থিত থাকেন চার থেকে পাঁচজন। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অবস্থাও একই রকম। তারা এরশাদের ডাকে সাড়া দেন না কিন্তু রওশন এরশাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তাছাড়া তৃণমূলে নেই জাতীয় পার্টির কোনো কর্মসূচি। অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। রাজধানীর দক্ষিণ জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে দিনের পর দিন। খোদ পার্টির নেতা-কর্মীরাই বলেন, সংসদে দলের তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। জাপা সরকারি দল না বিরোধী দল এটাই স্পষ্ট নয়। বঞ্চিত অনেক নেতা-কর্মী দল ছাড়ছেন। সব মিলিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে থাকা জাপা চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশে ২২৭ জন নেতা নির্বাচন থেকে সরে এসেছিলেন। তারা সারা দেশে জাতীয় পার্টি পরিচালনা করেছেন। তাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান মূল্যায়ন করেননি। তারা এখন পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাছাড়া নির্বাচন থেকে সরে আসা অনেক নেতাকে জেলা কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে শীর্ষ নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় তছনছ হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, সর্বশেষ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সংকট প্রকাশ পেয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান মেয়র প্রার্থীদের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রচারণার সময় কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে পাশে পাননি দলের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা। নির্বাচনের দিন শেষ পর্যন্ত ৯০ ভাগ কেন্দ্রে জাপার এজেন্টই পাওয়া যায়নি। এমনকি দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোও সক্রিয়ভাবে পাশে দাঁড়ায়নি। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৬ জন। এই তিন সিটিতে ভোট পড়েছে ১৮ লাখ ৫ হাজার ১৪৭। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী মোট ভোট পেয়েছেন ১৩ হাজার ৬০০, যা অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে পরাজিত প্রার্থীর চেয়েও কম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, লজ্জাকর এ পরাজয়ে মুখ দেখাতে পারছি না। প্রথমদিকে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে নির্বাচন থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু কী উদ্দেশে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে প্রার্থীদের চাপ দিয়েছিলেন তা আজ স্পষ্ট। এভাবে সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করে সাময়িক লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু দল চালানো যায় না। আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছি জাতীয় পার্টি করব কিনা।