দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে আসাকে ‘খারাপ ইতিহাস’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, এটা কোনো ভালো ইতিহাস নয়। এখন সরকার নিজেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, অনেক সময় ব্যাড হিস্ট্রি থেকে গুড নিউজ সৃষ্টি হয়।’ ঢাকা সফরের শেষ দিন গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন কৌশিক বসু। ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। তারা প্রকল্পে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুললে দীর্ঘ জটিলতার পর বাংলাদেশ সরকার ওই অর্থায়ন ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের টাকায় সেতুর কাজ শুরু করে।
গত ১২ ডিসেম্বর মূল সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকের ধারণা ছিল, কোনো কাজ করতে হলে অন্যের কাছে হাত পাততে হবে। এই মানসিকতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছু করতে পারব না। অমুককে ধরেন—টাকা পাব, তমুককে অনুরোধ করেন—টাকা পাব। তিনি আরো বলেন, আমি বলেছিলাম, এটা বন্ধ করেন। আমরা কারো টাকা নেব না। নিজেদের টাকাতেই করব।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পদ্মা সেতু নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কৌশিক বসু বলেন, পদ্মা সেতু, যেটা সরকার এখন নিজস্ব অর্থে নির্মাণ করছে, এই তো কাল না পরশু প্রধানমন্ত্রী এর মূল কাজ উদ্বোধন করলেন। সেটা একটা বিরাট সুখবর। এ কাজকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাই।
কৌশিক বসু বাংলাদেশকে দেখছেন এশিয়ার ‘নিউ ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে। তিনি বলেছেন, ১৯৫০ সালে হংকং-সিঙ্গাপুরকেও ‘এশিয়ার টাইগার’ বলা হতো না। কিন্তু তারা এখন সেই জায়গায় চলে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের খুবই সম্ভাবনা আছে। অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ দেশ। বাংলাদেশ ইজ আ নিউ এশিয়ান টাইগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে গত শনিবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকায় আসার পর থেকে যতবারই গণমাধ্যমের সামনে এসেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের একটি প্রসপেক্ট গ্রুপ আছে, যারা ফোরকাস্ট (প্রক্ষেপণ) করে থাকে। তাদের কাছ থেকে আমি যে বিশ্লেষণ পেয়েছি, তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। ১৯৯২ সালে রপ্তানি ছিল জিডিপির ৭ শতাংশ সেটা এখন ২০ শতাংশ হয়েছে। এক কোটি ৬০ লাখ লোক দারিদ্যসীমার ওপরে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
তিনি আরো বলেন, ২০০৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে যখন মন্দা চলছে, এর মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে এমন দেশের সংখ্যা ৫ থেকে ১০টার মতো। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।
তিনি বলেন, গত তিন-চার দিন আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি, সরেজমিন ঘুরে দেখেছি। আসার আগে আমি বাংলাদেশের কিছু পরিসংখ্যান দেখছিলাম। আসলে স্ট্যাটিসটিক্যালি বাংলাদেশ যতটুকু এগিয়েছে, দেখা যাচ্ছে—বাস্তবপক্ষে তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি বলতে চাই না সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখনো অনেক কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের উন্নয়ন করতে হবে। তবে এটা বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন যে স্তরে পৌঁছে গেছে, এখান থেকে ‘চড়চড়’ করে উঠে যাওয়া সম্ভব। এই বিষয়টি সাধারণ নাগরিকদের বোঝাতে হবে। চড়চড় করে উঠে যাওয়া বলতে তিনি তরতর করে উঠে যাওয়াকে বোঝাতে চেয়েছেন বলে পরে সাংবাদিকদের জানান।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক একসঙ্গে কাজ করবে।
বাংলাদেশ ‘চড়চড় করে’ এগিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে কৌশিক বসু বলেন, আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ নই। আমি জানি, বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষকরাও অর্থনীতির সমালোচনা করে থাকেন। সেটা ভালো। কিন্তু এখন বাংলাদেশ যে জায়গায় চলে এসেছে, তাতে সবাইকে কনফিডেন্স রাখতে হবে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে অর্থনীতি শেখা এই বাঙালির মূল্যায়ন, ১০ বছর আগে যে বাংলাদেশ ছিল—তা এখন নেই। তিনি বলেন, সাড়ে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি পৃথিবীর খুব কম দেশেই অর্জিত হয়েছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বেড়েছে।
বাংলাদেশের দুর্বল দিক কোনটি—এ প্রশ্নে কৌশিক বসু বলেন, অবকাঠামো এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক রাস্তাঘাট হচ্ছে, এদিকে আরো মনোযোগ দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনেও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।