দেশের মানুষের কাছে বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা এখন কোথায় আছে, পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে সেটা বুঝতেেএ বিষয়ে একটি জরিপ করা জরুরি। তবে জরিপ ছাড়াও সাধারণভাবে ধারণা করা যায় পরিস্থিতি কোথায় আছে। সঠিক পারসেন্টেজ কত না জেনেও এটা বলা যায় যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে নিম্ম আদালত এবং উচ্চ আদালত কোনোটিরই বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই।
বিশেষ করে বিগত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চাওয়া পাওয়া পূরণে উচ্চ আদালতের প্রভাবশালী বিচারপতিরা যেভাবে দলীয় ক্যাডার-সমর্থকের ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন তাতেই এটা স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে একমাত্র শেখ হাসিনার চাওয়া পূরণ করতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশকে গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুৎ করার পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক নামের আরেক ভারতীয় অনুগত আওয়ামী লীগ ক্যাডার বিরামহীনভাবে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি, জেল জুলুম দিয়ে গেছেন। বিচারপতি হিসেবে অবসর নেয়ার পরও আওয়ামী চিন্তাধারার ফ্যাসিস্ট অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে মাঠে নেমে বিচারবিভাগের উপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন।
এভাবে আরো বহু বিচারপতি/বিচারক ক্ষমতাসীনদের অনুগত থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এবং একই সাথে বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছেন। অন্যদিকে যারা আওয়ামী আনুগত্য শতভাগ করছেন না তাদেরকে পেছনের বেঞ্চে রাখা হচ্ছে। যথযোগ্য পদোন্নতি বা পদায়ন করা হচ্ছেনা।
এমন অবস্থায় গত বছর বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে জনাব সিনহার ‘আওয়ামী আনুগত্য’ নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।
কিন্তু গত ১৭ জানুয়ারি তার দায়িত্ব পালনের বর্ষপূর্তিতে নিজের দেয়া বানীতে প্রধান বিচারপতি এমন একটি কথা বলেছেন যা বিগত কয়ের বছরের বাংলাদেশি বিচারপতিদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ পদায়িত বিচারপতিদের, ঐতিহ্যের সাথে যায় না।
তিনি বলেছেন, বিচারপতিদের অবসরের যাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থী। তার এই বক্তব্যে বিগত কয়েক বছরে হওয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায়ের সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সেসব রায়ের মধ্যে রয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী, যেটির মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে বিচারপতি খায়রুল হক। তিনি অবসরে যাওয়ার পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেছিলেন। এরকম আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ রায় রয়েছে।
এই বক্তেব্যর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সুরেন্দ্র সিনহা যেই দলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি হলেন সেই দলেরই ক্ষমতায় থাকা প্রশ্নবিদ্ধ করে দিলেন! বিস্ময়করই বটে!
বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির যে নির্বাচন আয়োজন করেছিল তা পঞ্চম সংশোধনীর কারণেই সম্ভব হয়েছিল। আর পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক হলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও একই ধারায় পড়ে যায়।
কিন্তু জেনে শুনে সুরেন্দ্র সিনহা এমন কাজ করলেন কেন? আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলতে চান তিনি? কিন্তু ঘুরেফিরে তো তিনি নিজেও নিজের বক্তব্যে মাধ্যমে বিপাকে পড়ছেন। কারণ, এই ‘অসাংবিধানিক’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ‘অসাংবিধানিক’ সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। অসাংবিধানিক সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত কি অসাংবিধানিক নয়?
তো, এসব জেনেও তিনি এমন স্পর্শকাতর বক্তব্য (মুখ ফসকে নয়, লিখিতভাবে) দিলেন কেন? এটা কি কোন পরিকল্পনার অংশ? যে কারো সন্দেহ হতে পারে। অনেকে অবশ্য বলতে পারেন, শুধুই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বিচারপতি মানিককে উদ্দেশ্যে করে (বিপাকে ফেলতে) এমন বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তার মতো ব্যক্তির এবিএম খায়রুলের অবসরে গিয়ে রায় দেয়ার কথা ভুলে থাকার কথা নয়, যেটি তার নিয়োগকেও ‘অসাংবিধানিক’ করে দিচ্ছে।
অনেকে মনে করছেন, প্রধান বিচারপতির এই ‘সত্যকথন’ এটি পরিকল্পনার অংশ। আওয়ামী লীগ এটা ভাল করেই জানে যে, তার বক্তব্য যতই সঠিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ হোক না কেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এমন বক্তব্য থেকে কোনো ফায়দা উঠানোর সক্ষমতা রাখে না। যেমন, সুরেন্দ্র কুমারের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্ত হলে সেটা সামাল দেয়ার ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদের রয়েছে। আবার বিদেশী শক্তিগুলো নড়েচড়ে বসতে চাইলে সেটিও ‘কোনো বিশষে ক্ষমতাবলে’ সামাল দেয়ার সক্ষমতা আছে।
সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে রায় বের করে আনা, বা রাজনৈতিক হইচই তুলে ফায়দা উঠানো কোনো্টাই বিরোধীদের দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন বক্তব্যের মাধ্যমে সুরেন্দ্র সিনহার একটি ‘অসাধারণ সৎ ও নিরপেক্ষ’ ইমেজ তৈরি করা সম্ভব।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে নিরঙ্কুশভাবে এটা ঠিক। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি সবসময় বিরাজ করছে। কারণ সবাই জানে ও দেখছে, জোর করেই ক্ষমতায় আছে দলটি। এই অস্বস্তি দীর্ঘমেয়াদে ভাল নয়। এটা থেকে মুক্তি দরকার। একই সাথে এ ধরনের পরিস্থিতিতে থেকে উত্তোরণ চায় সরকারের প্রধান রক্ষক ভারত। কারণ, যুগ যুগ ধরে এভাবে জনগনের মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি সরকারকে সমর্থন দিয়ে ঠিকিয়ে রাখা যায় না। আর জনগনের মন জয় করে পছন্দের দলকে ক্ষমতায় রাখার মধ্যেই ভারতের লাভ বেশি।
এমন চিন্তাভাবনা থেকে ভারত তাদের বিশ্বস্ত সুরেন্দ্র কুমারকে হয়তো ব্যবহার করতে চায় জনগনের আস্থা অর্জনের একটি ঘুটি হিসেবে।
শেখ হাসিনা আভাস দিতে চান সামনে একটি নির্বাচন আসন্ন। গত বৃহস্পতিবার সিলেটে তিনি মানুষকে ওয়াদা করিয়েছেন নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য। নির্বাচনটা যে ‘মধ্যবর্তী’ হতেই হবে এমন নয়। বর্তমান মেয়াদ শেষের নির্ধানিত নির্বাচনকেই হয়তো শেখ হাসিনা টার্গেট করে আগাচ্ছেন এখন থেকেই।
আগামী নির্বাচন নিকটবর্তী হলে যে দুইটা প্রধান দাবি উঠবে সেগুলো হচ্ছে, ১. কার অধীনে নির্বাচন হবে। ২. নির্বাচন কমিশনের প্রধান কে হবেন?
বিএনপি এই দুইটা দাবি তুললেও তাদের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা এতে আওয়ামী লীগ ভাল করেই ধরে নিতে পারে যে, দুই দাবি ‘আমরা মানবো না’। এবং বাস্তবেও দুই দাবি না মানলেও আওয়ামী লীগের সমস্যা নেই। তারা আবার যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে। সমস্যা বিএনপির। দলটি যদি ভালভাবে আবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তাহলে অস্তিত্ব বিলীনের পথে এগোবে।
ফলে দাবিতে ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকবে বিএনপি। অন্যদিকে দেশের ভেতরে এবং বাইরে ‘অস্বস্তি’ দূর করতে কিছুটা ছাড় আওয়ামী লীগও দিতে রাজি আছে। তবে এই ছাড় দেয়াটা আওয়ামী লীগ করবে ক্ষমতায় ফেরার ব্যাপারে নিশ্চিয়তা পাওয়ার পরেই।
বিএনপির প্রথম দাবি- নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান নির্দলীয় থাকা- মানবে না আওয়ামী লীগ, বিএনপিও এটি মানাতে বাধ্য করাতে পারবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় দাবি- নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি নিয়োগ দেয়াটা আওয়ামী লীগ মেনে নেবে!
প্রশ্ন হচ্ছে, তখন এই ‘নিরপেক্ষ প্রধান নির্বাচন’ কমিশনার কোথায় পাওয়া যাবে? ২০০৬ এবং ২০১৪ সালে তো কারো ব্যাপারে একমত হতে পারেনি বিএনপি বা আওয়ামী লীগ।
তিন বছর পরে উঠতে যাওয়া এই প্রশ্নেরই উত্তর তৈরি করে রাখছে আওয়ামী লীগ। একজন ‘নিরপেক্ষ’ ভবিষ্যত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিজে রিহার্সেল দিচ্ছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
সিনহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি হওয়ায় আওয়ামী লীগের বাড়তি একটা সুবিধা হয়েছে যে, তিনি যদি মোটামুটি নিরপেক্ষতার ভান ধরে চলতে পারেন তাহলে বিএনপি তাকে চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ তখন তাদের বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অভিযোগ তোলা যাবে।
অন্যদিকে ভারতও এতে যারপরনাই সন্তুষ্ট থাকবে। সুরেন্দ্র কুমারের অধীনে নির্বাচনে পেশিশক্তির প্রদর্শন করে ইচ্ছামত কেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার মত যথেষ্ট আসন ছিনিয়ে নেবে। অন্যদিকে সুরেন্দ্র কুমার কিছু ‘কঠোর’ পদক্ষেপ নিয়ে তার নিরপেক্ষতা জাহির করবেন। গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোটচুরির চেয়ে সুরেন্দ্র কুমারের ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন পরিচালনার উদাহরণ প্রধান্য পাবে একচেটিয়া (মিডিয়ার এমন আচরণ গত পৌর নির্বাচনেও কিছুটা দেখা গেছে)। এরপর পর্যবেক্ষকরা রায় দেবেন, ‘তুলনামুলকভাবে অনেক সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে’ এবং ‘ইসির নিরপেক্ষতা তাদের দৃষ্টি কাড়বে’! আওয়ামী লীগও মোটামুটি স্বস্তিকর একটি পরিবেশে সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে।
এখন আশংকা আছে অন্যটাও। বিএনপি যদি দ্বিতীয় দাবি মানার পরও নির্বাচনে না আসে?
এই আশংকাকে মাথায় রেখে সরকার দুটি কাজ করে যাচ্ছে। ১. বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট ভাঙা। ২. বর্তমান গৃহপালিত সংসদীয় বিরোধী দলকে ‘গৃহ’ থেকে মুক্ত করে দেয়া।
সবাই জানেন ইসলামী ঐক্যজোটকে ২০ দল থেকে বের করে নেয়া হয়েছে। আরো একাধিক ইসলামি দল আছে যারা বের হয়ে যেতে পারে। সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমে এমন সংবাদ আসছে। একই সাথে ‘আসল বিএনপি’ ‘তৃণমূল বিএনপি’ ইত্যাদি গঠন করিয়ে বিএনপি ভাঙার চেষ্টাও চলছে সমান তালে। গত বৃহস্পতিবারই খালেদা জিয়ার এক ভাতিজাকে ফেনীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
সরকার এসব কাজ করাবে এবং মিডিয়াতে এগুলোর প্রচার হবে ‘বিএনপির ভাঙন’ বা দুর্বলতা হিসেবে। এমনিতেই মানুষের মাঝে ‘বিএনপির দুর্বলতা’ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তার সাথে সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমের প্রচারের ফলে এই ‘দুর্বলতা ও ভাঙন’ জনমনে আরো প্রতিষ্ঠিত হবে।
এতে সরকারের লাভ হলো, নির্বাচনে বিএনপির গুরুত্ব কমিয়ে ফেলার সুবিধা। যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নাও নেয় তাহলে সরকার যুক্তি দেখাতে পারবে, “এই দল বা জোট নির্বাচনে এলেই বা কী, না এলেই বা কী! ওদের রাজনৈতিক কোনো শক্ত অবস্থানই নাই।”
তবে শুধু এই যুক্তি দিয়ে যে পার পাওয়া যাবে না, তা আওয়ামী লীগ বুজে। এজন্যই তাদের দরকার ‘বিকল্প বিরোধী দল’ তৈরি করে রাখা।
জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক কথিত ‘নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী’ বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টা সরকারের এই ‘বিকল্প চিন্তার’ই অংশ। পাঁচ বছর ধরে গৃহপালিত বিরোধী দল এবং সরকাররে অংশ থাকার পর হুট করে আগামী নির্বাচনের আগে ‘নিরপেক্ষতার’ ভান ধরলে এটা কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফলে শেখ হাসিনা আগে থেকেই পথ আঁটছেন।
সামনের নির্বাচনের এখনো তিন বছর বাকি। এই সময়টুকু তিনি জাপাকে সংসদে ‘কার্যকরী’ করে তুলতে চান। যাতে বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে যেতে হলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা এখনকার মতো ঠুনকো না হয়ে যায়।