পাঠক মাত্রই বিখ্যাত লেখক মারিও পুজোর ‘গডফাদার’ বইটি সম্পর্কে অবগত। অনেকে হয়তো এখনও বইটি না পড়লেও হলিউডের কল্যাণে গডফাদার চলচ্চিত্রটি দেখে নিয়েছেন। এরকম অনেক পাঠক আছেন যারা গডফাদার বইটি পড়ার পরেও সংশয়বাদী মন থেকে মাফিয়াদের নিয়ে অতটা ভাবতে রাজি নন। অথবা বলা ভালো, মাফিয়ারা যে রীতিমতো ভয়ংকর সেটা মানতে তারা নারাজ। কিন্তু পাঠক, মানুন আর নাই মানুন মাফিয়ারা যে ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ড ঘটাতে ওস্তাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাফিয়া অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত ইতালির সিসিলি। এই সিসিলির মাফিয়া পরিবারের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ ক্যালাব্রিয়া অঞ্চলের ‘নাদ্রাংহেতা ক্রাইম সিন্ডিকেট’ পরিবার। যদিও স্থানীয়দের কাছে এই গ্রুপটি ‘কসা নস্ত্রা’ নামেই অধিক পরিচিত। অন্যান্য মাফিয়া পরিবারগুলো নিজেদের অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা বিস্তার করলেও কসা নস্ত্রা পরিবার নিজেদের অঞ্চলের বাইরে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত অধিপত্য বিস্তার করেছে। ইতালির একজন বিশেষজ্ঞ দেমোস্কোপিকার মতে, কসা নস্ত্রা পরিবার গত ২০১৩ সালেই শুধুমাত্র ব্যবসা থেকে মুনাফা অর্জন করেছে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থের পরিমান প্রায় ম্যাকডোনাল্ডস এবং ডাচ ব্যাংকের বাৎসরিক মুনাফার দ্বিগুন। শুধু তাই নয়, ইতালির মোট জিডিপির তিনভাগের একভাগ একাই উপার্জন করেছে এই পরিবারটি।
ইউরোপের অবৈধ কোকেন সাম্রাজ্যের আশি শতাংশই নিয়ন্ত্রন করে কসা নস্ত্রা পরিবার। কোকেন ব্যবসার বাইরে পরিবারটি সম্প্রতি ইতালি, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিতে আবাসন ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়েছে। এছাড়াও এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশেও এই পরিবারটির বিভিন্ন নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, যার সঠিক খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।
কসা নস্ত্রার উপর বিস্তর গবেষণা করেছেন ইতালির গবেষক অ্যান্টনিও নিকাসো। তার ভাষ্য মতে, ‘নস্ত্রা পরিবার হলো বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের অন্যতম উদাহরণ। যারা সত্যিকার অর্থেই গোটা বিশ্বে কাজ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এই পরিবারটি ক্যালাব্রিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কলম্বিয়া এবং ফ্রান্সে পাঠায়। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষায় তারা পারিবারিক সম্পর্ককে এগিয়ে রাখে।’
মূলত, ১৯৬০ থেকে ৭০ সালের মধ্যে এই মাফিয়া পরিবারটি অপহরণ এবং হত্যার ভেতর দিয়ে আলোচনায় আসে এবং অর্থ বাজারে খাটাতে শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা সিসিলির স্থানীয় গুন্ডাদলগুলোকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে যাতে তারা কোকেন ব্যবসা চালাতে পারে। স্থানীয় গুন্ডারা কসা নস্ত্রার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার পরেই মূলত বর্হিদেশে কোকেন বাণিজ্যের দিকে তারা মনোযোগ দেয়। বিদেশের মাটিতেও তারা একই কৌশল খাটিয়ে ব্যবসা করে। ইতালির স্থানীয় সাংবাদিক গুয়েসপ্পে ক্যাতোজেল্লার মতে, নস্ত্রা পরিবারটির এখন অন্যতম সমস্যা হলো তাদের অর্জিত অর্থ। কারণ তাদের হাতে খরচ করার চেয়েও বেশি অর্থ চলে এসেছে। গত বছর এই পরিবারের অন্তর্ভূক্ত একটি গ্রুপ আলভেরা জঙ্গলে মাটির তলায় কয়েক মিলিয়ন ডলার লুকিয়ে রাখে পরবর্তীতে খরচের জন্য। কিন্তু একটা সময় দেখা যায় আর্দতার কারণে সব অর্থই নষ্ট হয়ে যায়। সেসময় ওই গ্রুপটির পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে নিতান্ত দুর্ঘটনা বলে আখ্যা দেয়া হয়।
১৯৮০ সাল অবধি সফল অভিযানের পর কসা নস্ত্রা রাষ্ট্রবিরোধী নীতি গ্রহন করে। জিওভান্নি ফ্যালকানো এবং পাওলো বোরসেলিনোর মতো দুই বিজ্ঞ বিচারককে এই পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা করা হয় ১৯৯২ সালের দিকে। এই দুই আইনজীবি গোটা ইতালিতে মাফিয়া বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন। এই ঘটনা পরবর্তীতে তৎকালীন ইতালি সরকার মাফিয়াদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য নতুন একটি সশস্ত্র সরকারি বাহিনী তৈরি করে। এই বাহিনী মাফিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন অনেককেই গ্রেপ্তার করে সেসময়। এরপর দীর্ঘদিন নস্ত্রা পরিবারের প্রকাশ্য কর্মকান্ড বন্ধ থাকে। কিন্তু ২০০০ সালে আবারো পরিবারটি মাথাচাড়া দিতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা ঘটনার পর ইতালির আভ্যন্তরীন ঘটনাও পাল্টে যেতে শুরু করে। দেশটির সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয় এবং মাফিয়া নিধনে যে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হতো তাদের সরিয়ে নিয়ে আসে। পাশাপাশি গোটা ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি কসা নস্ত্রা পরিবারকে আরও একবার সুযোগ করে দেয় নিজেদের কার্যক্রম বিস্তৃত করার। পরিবারটির অর্থ দিয়ে কয়েক হাজার ব্যবসায়ি রাতারাতি দক্ষিণ ইউরোপে ছড়িয়ে যায় এবং তরল অর্থ কামাতে শুরু করে। যেহেতু ইউরোপের অর্থ সঙ্কটের কারণে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িদের কাছে তরল অর্থ কম ছিল, সেই স্থানে নস্ত্রা পরিবারের তরল অর্থ বাজারে নিয়ে এসে প্রতিদ্বন্দিতা শুরু করে হাজারো ব্যবসায়ি।
এপর্যন্ত এই মাফিয়া পরিবারটির উপর বেশ কয়েকবার আঘাত এসেছে। ইন্টারপোল থেকেও কয়েকবার রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে পরিবারটির উপর। কিন্তু এতো কিছু স্বত্ত্বেও আদলে মাফিয়া পরিবারটির কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ অনেক বছরের ভিত্তি এতো সহজেই ধ্বংস করে দেয়া সহজ নয়। গোটা ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে কসা নিস্ত্রা পরিবারের রয়েছে অসংখ্য আউটফিট। এই পরিবারের সদস্যরা কোথায়, কোন দেশে বাস করেন তা কেউ জানেন না। হয়তো তারা সাধারণ মানুষের বেশেই ইতালির কোনো ক্ষুদ্র গ্রামে বসবাস করছেন। এমনকি এই পরিবারের কোনো সদস্যের ছবিও কোথাও নেই, যা তাদের চিহ্নিত করতে পারে।