রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ কমে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম।
এর প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। এটি আগামী দিনে আরও বাড়বে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করে যেতে পারে। চলতি বছরে খাদ্যসূচক ১৮ শতাংশ বাড়বে। আগামী বছর তা ৬ শতাংশ কমতে পারে। তবে ২০২৪ সালে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারে।
শুক্রবার রাতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, দেশটিতে খাদ্যের দাম বাড়ছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। গত আগস্টে এ হার বেড়ে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উঠেছে। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ খাদ্য আমদানি করে বলে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে। একই সঙ্গে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান পড়ে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই সপ্তাহ আগে বিশ্বব্যাংক কৃষি উৎপাদনের যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, এর চেয়ে এখন আরও ২ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এতে সার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একই সঙ্গে বাড়ছে কৃষি উপকরণ ও সারের দাম। এতে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে উৎপাদন কমে যাবে।
উৎপাদন কমলে দামও বাড়বে, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারকে উসকে দেবে। তবে খাদ্যসামগ্রীর রপ্তানির সূচক ১ শতাংশ বেড়েছে। এটি নির্ভর করছে কৃষ্ণসাগর দিয়ে পণ্য পরিবহণে নিরাপত্তার ওপর। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহণে নানা ঝুঁকি বেড়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লেই পণ্যবাহী জাহাজে আক্রমণ হচ্ছে।
গত এক বছরের মধ্যে এখন গমের দাম ২৫, ভুট্টা ২৯ এবং চালের দাম ১০ শতাংশ বেশি। যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিকভাবে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় এখন পর্যন্ত ২৫টি দেশ খাদ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মধ্যে ২০টি দেশ ২৪ ধরনের খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে।
খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। বাড়বে ক্ষুধার্ত ও পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা, যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এদিকে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ৫ হাজার কোটি ডলার এবং সার ও কৃষি খাতে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ২০২১ সালের নভেম্বরের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে। ওই সময় থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। গত বছরের নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ হয়েছে।
বাংলাদেশে শীতকালে সবজি-চালের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ার কারণে দামও কমে যায়। এতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কম থাকে। কিন্তু করোনার প্রভাবের কারণে এ হার বেড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও ঊর্ধ্বগতি হয়। জানুয়ারিতে এ হার বেড়ে ৫ দশমিক ৭, ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ২ এবং মার্চে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হয়। মে মাসে এ হার এক লাফে বেড়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর জুন ও জুলাইয়ে এ হার ৮ শতাংশের ওপরে ছিল।
জুনে ৮ দশমিক ৪ এবং জুলাইয়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ডাবল ডিজিটের কাছকাছি চলে যায়। আগস্টে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ছাড়াও বৈশ্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় এ খাতে মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮ দশমিক ৪, নেপালে ৮ দশমিক ২, পাকিস্তনে ৩৬ দশমিক ২, শ্রীলংকায় ৮৫ দশমিক ৬ এবং মালদ্বীপে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
আফগানিস্তানেও এ হার অনেক বেশি। তবে মালদ্বীপ খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। তাদের মুদ্রার মানও স্বাভাবিক রয়েছে। তবে শ্রীলংকা ও পাকিস্তান নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে।
অন্য দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৪, মিয়ানমারে ১৬ দশমিক ১, ফিলিপাইনে ৯ দশমিক ৮, ভিয়েতনামে ৫ দশমিক ৬, চীনে ৮ দশমিক ৮, মালয়েশিয়ায় ৬ দশমিক ৯, থাইল্যান্ডে ৯ দশমিক ৬, কানাডায় ১০ দশমিক ৩, সিঙ্গাপুরে ৬ দশমিক ৯, যুক্তরাজ্য ১৪ দশমিক ৯ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১১ দশমিক ২ শতাংশ।
jugantor