মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজিত হবে তা হয়তো কারও মনোজগতেই আসেনি। একযুগের বেশি সময় আগে যখন কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের ঘোষণা এলো, সবাই অবাকই হয়েছিল। মাত্র ১১৫৮১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি দেশে কীভাবে তা সম্ভব? যেই দেশটির আবার কোনও সময়ই বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতাও নেই, নেই ফুটবল ঐতিহ্যও। অনেক বিতর্ককে একপাশে রেখে সময়ের পরিক্রমায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে তেল-গ্যাসে ভরপুর দেশটি। বলতে গেলে মরুর বুকে সফল একটি মহাযজ্ঞ দেখেছে সবাই। যার শেষটা হয়েছে চরম আকর্ষণীয়। লিওনেল মেসি তথা আর্জেন্টিনার হাতে উঠেছে মহামূল্যবান সোনালি ট্রফি।
অথচ বিশ্বকাপের ভেন্যু হওয়ার জন্য আড়ালে-আবডালে অনেক কিছুই করতে হয়েছে কাতারকে। এর জন্য অনেক কথাই শুনতে হয়েছে তাদের। এক শীর্ষ কর্মকর্তা তো দীর্ঘমেয়াদে সাসপেনশনের খড়গ নিয়ে আছেন।
ভেন্যু প্রাপ্তির পর অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তীরও গেছে তাদের দিকে। বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তো প্রতিনিয়ত ছিল সোচ্চার। আর পশ্চিমারা তো সুযোগ পেলেই সমালোচনার বন্যা বইয়ে দিয়েছে। ‘প্রচুর শ্রমিকের মৃত্যুতে’ তখন এক ধরনের চাপে ছিল কাতারের সরকার তথা রাজপরিবারও। এছাড়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে দোহা থেকে অধিকাংশ শ্রমিককে সরিয়ে নেওয়া কিংবা বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াটা ছিল দৃষ্টিকটু।
এরপরও তারা হতোদ্যম হয়নি। একটু একটু করে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছিল। নভেম্বরের ১৭ তারিখে কাতারে এসে বিশ্বকাপের ভেন্যু, অবকাঠামো ও পরিবেশ দেখে একটু একটু করে পরিষ্কার হয়েছিল কোনও কিছুতেই কমতি রাখা হয়নি। যেখানে বিশ্বমানের যা দরকার তা-ই করা হয়েছে। খেলোয়াড়, সমর্থক ও মিডিয়াকর্মীদের জন্যও।
সাধারণত গ্রীষ্মকালে বিশ্বকাপ ফুটবল হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের গরমের কথা চিন্তা করে শীতকালে এবারই প্রথম আয়োজিত হলো। আটটি স্টেডিয়ামে তাপমাত্রা কৃত্রিমভাবে ২১ ডিগ্রির মধ্যে রেখে চমকই দেখানো হয়েছে।
আয়োজক ও ফিফা মিলে চেয়েছিল অন্তত ১৫ থেকে ১৭ লাখ সমর্থক বাইরে থেকে এসে খেলা দেখবেন। কিন্তু আদতে তা ১০ লাখও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এর পেছনে কারণও আছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে সমকামিতা ছাড়াও স্টেডিয়ামে মদ্যপান নিয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পশ্চিমারাসহ অনেকেই আর সরাসরি এখানে এসে খেলা দেখতে উৎসাহ পাননি।
তবে যারাই এসেছেন সবাই নেচে-গেয়ে মরুর বুকে বিশ্বকাপ উপভোগ করেছেন। তাদের নিজস্ব ঢঙে পোশাকে চলাফেরা করতে কোনও সমস্যাই হয়নি। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও কঠিন অনুশাসনের দেশ নয়, ইউরোপের মতো কোনও স্বাধীনচেতা দেশে হাঁটছেন-ফিরছেন অনেকেই!
এখানে সব জায়গায় বিশ্বকাপের উত্তাপ দেখা মেলেনি। নির্দিষ্ট ফ্যানজোন ও ভেন্যুতে ছিল উৎসবের আবেশ। এমনিতে কাতারিরা দিনে বাইরে বের হন কম। তাদের দেশে বিশ্বকাপ আর তাদের উপস্থিতি চোখে পড়েছে কমই। শুধু খেলার দিন আরবীয় পোশাক পরে তাদের দেখে মনে হয়েছে বিশ্বকাপ তাদের দেশেই হচ্ছে!
এত আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কের পরও একটি সফল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পেরেছে কাতার। এশিয়াতে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার পর বিশ্বকাপ আয়োজন করে যে সাহস দেখিয়েছে, তার জন্য প্রশংসাই প্রাপ্য তাদের।
বিশ্বকাপ আয়োজন করতে ২২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে কাতার সরকার। কোনও জায়গায় যেন কমতি না থাকে সেদিকে দৃষ্টি ছিল তাদের। তারা চেয়েছে বিশ্বকাপের মাধ্যমে তাদের নতুনভাবে বিশ্ববাসী চিনুক-জানুক। এক অর্থে ২২তম মহাযজ্ঞের আসর সফলভাবে আয়োজন করে তার সার্থক রূপও দেখেছে।
আগামীতে কোনও বিশ্বকাপের আসর এত ছোট আয়তনের দেশে হবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় আছে। যেখানে বলতে গেলে এক শহরে সব ম্যাচ হয়ে গেলো। কাতার আসলে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলো।
ফাইনাল শেষে কাতারের আমির শেখ থানি লিওনেল মেসির গায়ে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে দেওয়ার সময় তার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসির রেখা ঝুলছিল। এত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এমন এক সফল আয়োজনের পর তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্মরণকালের সেরা বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছে কাতার। সব মিলিয়ে কাতার লেটার মার্ক পেয়ে উতরে গেছে। এখন অপেক্ষা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকো বিশ্বকাপের।