ওসমান এহতেসাম
‘শুনলাম এইবারও নাকি এভিলেমে (ইভিএম) ভোট হইবো, তাই সিদ্ধান্ত নিছি এইবারও ভোট দেমুনা। ভালো কইরা একটা মোবাইল নাম্বার-ই ঠিক মতো তুলতে পারিনা আবার নাকি এভিলেম (ইভিএম) চাইপা ভোট!’ চট্টগ্রামের একটি চায়ের দোকানে এমন আলোচনাই উঠে এসেছে দুই রিকশা চালকের কথোপকথনে। বুঝলাম দেশে জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচনের এখনো বাকি এক বছরের উপরে। এ নিয়ে এখনই চলছে না কল্পনা জল্পনা, সমর্থন এবং বিরোধীতা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের শুরুটা খারাপ ছিল না। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একের পর এক সংলাপ করে আসছে নির্বাচন কমিশন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা এই সংলাপে দুইটি বিষয় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তা হলো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন এবং নির্বাচনকালীন সরকার। কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। বাকি দলগুলো যথারীতি সংলাপে অংশ নিয়েছে। নিজেদের মতামত দিয়েছে। সিইসি সবার কথা শুনেছেন, কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন নিজের মতো করে। হঠাৎ জানিয়ে দিলেন ইভিএম ব্যবহার করা হবে। আর সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে তখন। যেখানে একাংশ জনগণ ঠিক মতো ইভিএম-ই উচ্চারণ করতে পারে না, তারা ইভিএম ব্যবহার করবে কিভাবে? এখানেই তো নির্বাচন কমিশনের প্রথম ব্যর্থতা, সিদ্ধান্তের ব্যর্থতা। আমন্ত্রিতদের মতামত যখন গ্রহণ-ই করবেন না, তখন ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘সংলাপ’ নামক নাটকের আয়োজন করার কি প্রয়োজন ছিল? নিঃসন্দেহে তথাকথিত সংলাপের নামে তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে। প্রতিটি সংলাপ শেষেই নির্বাচন কমিশনের কেউ না কেউ মিডিয়ায় ব্রিফ করতেন এবং তা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশ প্রচার হতো। কাজেই প্রতিটি বৈঠকের প্রস্তাবিত মতামত কারো অজানা থাকার কথা নয়, অথচ কি দেখলাম? সংখ্যা গরিষ্ঠ মতের কিছুই রাখা হল না। প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ? ইভিএম নিয়ে ইসির যে আগ্রহ দেখা যায় তা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা দুইটি সিদ্ধান্তে পৌছানে পারি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হলেও প্রকৃত পক্ষে তারা স্বাধীন নয়। কাজেই অন্য কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ইভিএম এর প্রতি তাদের এই আগ্রহ। তারা কোনো এক দলের রাজনৈতিক ইশারাকে অনুকরণ করছে। এটি একটি যৌক্তিক কারণ হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নিই, নির্বাচন কমিশন আসলেই স্বাধীন, তারা কোন দলকে অনুকরণ করেন না, তাহলে ইভিএম নির্বাচনী প্রয়োজনে নয় বরং বাণিজ্য করতেই তাদের এই আগ্রহ। অধিকাংশ দলের ‘না’ সত্ত্বেও ইভিএম কেনার এই অতি উৎসাহিত সিদ্ধান্ত তারই ইঙ্গিত দেয়।
উপরের দুটি কারণের যেকোনো একটিকে কিংবা দুটোকেই লক্ষ্য করে এগোচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। একটি দলের হয়ে কাজ করে দলকেও খুশি করা গেল, আবার ইভিএম কিনে অর্থও আয় করা গেল।
ইভিএম বিতর্কিত যন্ত্র, ভোট চুরির যন্ত্র। বিরোধীদের এমন বক্তব্যের পর অনেক রাজনৈতিক নেতাকেই আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের ইভিএম ব্যবহারের উদাহরণ আনতে দেখা যায়। কিন্তু তারা তা জানে না আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উন্নত বিশ্বে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ব্যালটের সাহায্যকারী উপকরণ হিসেবে। অন্যদিকে আমাদের দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয় নির্বাচনের একমাত্র প্রদান মাধ্যম হিসেবে। মার্কিন মুলুকে ভোটের ফলাফল ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে তারপর ঘোষণা করা হয়। সে দেশে ইভিএমে যে ভোট প্রদান করা হয় সেটি যেমন ভোটিং মেশিনে সংরক্ষিত হয়, তেমনি ইভিএম মেশিনের সাথে একটি প্রিন্টার থাকে, যেখানে ভোটারের প্রদেয় ভোটের ফলাফল সাথে সাথে প্রিন্ট আকারে বের হয়ে যায়। এরপর ভোটাররা সাধারণ ব্যালট পেপারে সনাতন পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে তা ব্যালট বাক্সে পুরে দেন। এর পর তিনটি পদ্ধতির ফলাফল একই হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে একটি মাধ্যমকে ব্যবহার করায় ভোট গণনার হিসাব গরমিল হলে বোঝা যায় না। যদি কোনো প্রার্থী চ্যালেঞ্জ করেন, নির্বাচন কমিশন সেটা কীভাবে প্রমাণ করবে যে গণনা ঠিক আছে?
তারপরও রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এতে ২ লাখ ইভিএমে খরচ ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা (প্রথম আলো)। সে হিসেবে প্রতি ইভিএমে খরচ পৌনে ৪ লাখ টাকা। আজ থেকে চার বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ তে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি ইভিএমের দাম পড়েছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা এবং তখন ভারতে ছিল ২১ হাজার ২৫০ টাকা (প্রথম আলো)। সে হিসেবে একটি নির্বাচনের ব্যবধানে আমাদের দেশে এর দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ! এতো আমাদের দেশের তুলনা। ১৮-তে যে ইভিএম ক্রয় করা হয় তা ছিল ভারতের চেয়ে এগারো গুণ বেশি। তাহলে বর্তমানে কত! জনগণের টাকার অপচয় গণনা করে সইতে পারবো না বলে তা গণনা করা হয়নি, হিসাবটা আপনারাই করে নিবেন। তবে ইভিএম ব্যবহার না করার নানা যৌক্তিকতা রয়েছে। কয়েকটি যৌক্তিকতা তুলে ধরেই আজকের নিবন্ধন শেষ করব।
অপ্রশিক্ষত জনগণ –
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত শিক্ষার হার বাড়ছে যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য একটি অংশ রয়েছে যারা শিক্ষার সুযোগ পায়নি। দিনে খেটে যাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আরেকটি অংশ বৃদ্ধ। ‘২৫ বছর পর দেশ হবে প্রবীণের’- এটি গত ১ অক্টোবর দেশ রূপান্তর পত্রিকার শিরোনাম। কাজেই প্রবীণদের কথাও ভাবতে হবে। তারা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত না। তাদের কাছে ইভিএম কেবল একটি জটিল যন্ত্রের নাম। যার আলোচনা আমার নিবন্ধনের শুরুতেই এসেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ইভিএম এর ব্যবহার নিয়ে মেসেজের মাধ্যমে ইসির প্রচার-প্রচারনা লক্ষণীয়। কিন্তু সে প্রচারণায় মানুষ কতটা দক্ষ হয়ে উঠবে তা ভাবার বিষয়। ৯ অক্টোবর আমার মুঠোফোনে তাদের পাঠানো মেসেজে লেখা ছিল- ‘ইভিএমে ভোট দিতে পছন্দের প্রতীকের পাশের সাদা বাটন এবং ভোট নিশ্চিত করতে সবুজ বাটন চাপুন।’ আচ্ছা ভাবুন তো, শিক্ষা বঞ্চিত মানুষ কি এই মেসেজ পড়তে পারবে? আর যারা পড়তে পারে তারাইবা কি শিখবে? এখানে তো দক্ষ হওয়ার মত কোন বিস্তারিত আলোচনা নেই।
বাংলাদেশে ইভিএম এর ব্যবহার শুরু হয় ২০০৭ সালে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে (উইকিপিডিয়া)।এরপর বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অল্প পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হলেও গত ১৫ বছরেও প্রশিক্ষিত জনগণ গড়ে তোলা যায়নি। কাজেই কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন রেডিও, টেলিভিশন ও মসজিদ-মন্দিরে ইভিএম এর প্রচারণা চালানো হবে বলে যে বক্তব্য দেন- তা সত্যিই হাস্যকর। যে প্রতিষ্ঠান ১৫ বছরে পারল না তারা ১ বছরে কিভাবে পারবে! আর নয় তো বর্তমান আউয়াল কমিশনকে ইভিএম জাদুকর বলা ছাড়া উপায় নেই।
ইভিএমে অনাস্থা ও ভীতি –
গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বর্তমান নির্বাচন পর্যন্ত ভোটারদের অনুপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। মানুষ বহুকাল থেকে মাঠের খরার সাথে পরিচিত কিন্তু নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রে যে খরা, তার সাথে পরিচয় ঘটেছে ২০১৪ থেকে। যখন বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। এরপর থেকে সে খরা আর কাটতে দেখা যায়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা’র নেতৃত্বে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচন শেষে তার মুখে একটি মুখস্ত বুলি ছিল, তা হল- শীতের সকাল তাই ভোটার কম হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল- ইভিএম জটিলতায় প্রবীণ এবং শিক্ষা বঞ্চিত মানুষরা ভোট দিতে আসেননি। তার বাস্তব প্রমাণ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন। যেখানে দুই ঘণ্টায় ১ ভোট পড়ায়, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পোলিং অফিসার! (যুগান্তর, ৩১ জুলাই ২০২২) আগের প্যারায় বিভিন্ন মাধ্যমে ইভিএমের প্রচার-প্রচারণার কথা বলেছি। সবার ঘরেই রেডিও- টেলিভিশন আছে, কিন্তু কি হবে এই প্রচার করে যদি জনগণের শেখার আগ্রহ না থাকে। বিগত দিনের পর্যবেক্ষণে দেখেছি, ইভিএমে ভোট দেয়া ও শেখার প্রতি আগ্রহ নেই জনগণের। অনেকেই মনে করে ইভিএম প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল যন্ত্র। ইসি, তাদের কর্মকর্তা, কারিগরি দল, প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ইভিএমে জালিয়াতি করতে পারেন। তাই ইভিএম ও ইসির ওপর মানুষের আস্থা নেই। তা আরও পরিষ্কার হয় কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম দেখলে। ‘সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বিরুদ্ধে নৌকায় ‘ভোট মারার’ অভিযোগ।’ এটি গত ১৫ জুন ঢাকা প্রকাশ এর শিরোনাম। এতে বলা হয়, নবম ধাপে অনুষ্ঠেয় রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনার ইউপি নির্বাচনের একটি কেন্দ্রে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বিরুদ্ধে নৌকা মার্কার প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অভিযোগ করেছেন এক নারী ভোটার। এরকম হাজারো উদাহরণ দিলে দেওয়া যায়, এতে নিবন্ধন লেখা শেষ হবে না। তাই উদাহরণ টানা শেষ করলাম।
ফিঙ্গার প্রিন্ট বিড়ম্বনা ও ধীরগতি –
নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইভিএমে দ্রুত ভোট প্রদান সম্ভব বললেও তা মূলত একটি জটিল ধীরগতি যন্ত্র। আঙ্গুলের ছাপ না মিলায় বাংলাদেশের ভোটারদের ভোগান্তিও কম দেখিনি অতীতে। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভোট দিতে না পারার কষ্ট মানুষের চোখে মুখে বহুবার দেখেছি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মিলাসহ নানা জটিলতায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ খুব ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়। পৌনে এক ঘণ্টায় ১৫ ভোট (সমকাল) এমন শিরোনামও এখন আমাদের পড়তে হয়! মনে থাকার কথা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) আঙ্গুলের ছাপ মিলেনি স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরসহ অনেকেরই। পরে তারা তিনজনই সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বিশেষ ক্ষমতা বলে ভোট প্রয়োগ করেন। তারা বিশেষ ব্যক্তি বলেই হয়তো বিশেষ ক্ষমতা বলে ভোট প্রয়োগ করতে পেরেছেন। কিন্তু সাধারণ ভোটারদের অনেকেই ভোট না দিয়ে চলে যেতে হয়েছে। কামরাঙ্গীরচরের ভোটার রহিমা বেগম। বহু কষ্টে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ভোট দিতে এসেছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোটার চিহ্নিত করার জন্য আঙুলে ছাপ দিচ্ছেন, কিন্তু মিলছে না। এভাবে কয়েকবার চেষ্টার পরেও মিলছে না তার আঙুলের ছাপ। নির্বাচনী কর্মকর্তা ব্যর্থ হয়ে তাকে ফিরে যেতে বলেন। পথিমধ্যে এক সাংবাদিকের কাছে রহিমা অভিযোগ করে বলেন, আমার নিজের বাড়ি কামরাঙ্গীরচর। স্বামীর বাড়ি কেরানীগঞ্জ। শুধু মাত্র ভোট দেয়ার জন্য বহু কষ্টে নদী পার হয়ে ভোট দিতে এসেও দিতে পারলাম না। আমি ভোট দিতে চাই। (মানব জমিন, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০)।
নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইভিএম ওভাররাইট করার ক্ষমতা –
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, একেকটি নির্বাচনে সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের একেক ধরনের ক্ষমতা দেয়া থাকে। ওই এলাকার ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্টতার হারের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ি ইভিএম মেশিনে ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার পরই ভোট দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু মেশিনের সঙ্গে আঙ্গুলের ছাপ না মিললে তখন সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে উক্ত ভোটারকে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিবেন। আমরা নিশ্চয় ভুলিনি, গত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন বাস্তবতায় ২০১৮ সালে মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করে। এ সময় ২৫ শতাংশ ভোটের ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইভিএম ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, যার মানে ওই কর্মকর্তার ২৫ শতাংশ ভোট নিজের পছন্দমতো প্রার্থীর পক্ষে দেয়ার অধিকার ছিল (প্রথম আলো, ৬ জুন ২০২২)। তাই চাইলেই নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা তার পছন্দের প্রার্থীকে সহজে পক্ষপাত দুষ্ট ভোট দিতে পারেন।
ইভিএম হ্যাক ও ফলাফল বদল –
ইভিএম হ্যাক করা যায় না বলে ইসি যে দাবি করছে তা প্রমাণিত নয়। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে কত সহজে ইভিএম হ্যাক করা যেতে পারে তাই হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সে দেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী। মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এলেক্স হাল্ডারম্যান দেখিয়েছেন কত সহজে ইলেষ্ট্রনিক ভোটিং মেশিন হ্যাক করে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হলে কারা ও কিভাবে তা করেছে বা আদৌ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কিনা তা ধরার কোনো উপায়ও থাকে না সেটাও দেখিয়ে দিয়েছেন হাল্ডারম্যান। বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য প্রকাশ করেছেন (দৈনিক ইনকিলাব, ৮ অক্টোবর ২০১৮)। তাই এই সন্দহের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। অনেকেই মনে করছেন পছন্দের মার্কায় ভোট প্রদানের পর তা বদলে দেওয়া সম্ভব। তাই ইভিএমে আগ্রহ নেই অনেকের।
বিভিন্ন রাষ্ট্রে ইভিএম বাতিল করায় শঙ্কা –
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। ভোটদানের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা না থাকায় অনেক দেশ ইভিএম পরিত্যাগ করেছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে। বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য। সম্প্রতি ভারতেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। বর্তমানে পুরোপুরি ইভিএম চালু আছে শুধুমাত্র ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং এস্তোনিয়ায় (https://www.jagranjosh.com/general-knowledge/which-countris-use-electronic-voting-machines-1548418168-1)। এ নিয়ে আমাদের দেশেও সন্দেহের বাসা বেধেছে। উন্নত দেশগুলো কেন ইভিএম পরিত্যাগ করেছে তা আগে অনুধাবন করতে হবে। ইভিএমে ভোটদানের পর ভোটার কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেন না।
কেন্দ্র দখল ও গোপন কক্ষে ভূত –
কেন্দ্রে বুথ দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেয়া সম্ভব’ বলে মন্তব্য করেছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রফিকুল ইসলাম। আমরাও হয়তো আর মন্তব্যে দ্বিমত পোষণ করবো না।
এই প্রথম নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করল। কিন্তু কেন? কারণ নির্বাচন কমিশন স্বচক্ষে বুথের ভেতর ভূত দেখেছে! এই ভূত কেন্দ্র দখল করে অন্যের ভোট নির্দ্বিধায় দিয়ে দেয়। অন্যদিকে প্রকৃত ভোটার ভূতের আছর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু না বলেই চলে যান। কেন্দ্র দখল করে যে জাল ভোট সম্ভব তার প্রমাণ দিয়েছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তোমার আঙুল, আমি টিপ দেবো, ওটা হলো সুষ্ঠু ভোট।’ (প্রথম আলো, ৪ জুন ২০২২)।
‘ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে- একটা ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে- আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান, দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২২)। এটি সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো: আহসান হাবিব খানের বোমা ফাটানো উক্তি। আর তার এই উক্তিকে চিরন্তন সত্যে রূপ দিলেন এই আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
ইসি-প্রার্থী সাক্ষী –
কথায় আছে সত্য কখনো গোপন থাকে না, গোপন থাকেনি ইভিএমের ক্ষেত্রেও। ইভিএম মেশিনকে ব্যবহার করে যারা ক্ষমতায় এসেছেন কিংবা উপকৃত হয়েছেন এমনই দু’জন এবার সাক্ষীর কাতারে। আগের তুলনায় তারা বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়তায় অবস্থান করছেন। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি। ২০০৬ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির ঐক্য। তাই এই দুই দলকে একে অপরের পরিপূরকও বলা হয়। আর সরকারের বন্ধুদল জাতীয় পার্টির এই নেতার বক্তব্যই বোঝা যায় ইভিএম কতটা অসচ্ছ প্রক্রিয়া। ৩১ জুলাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলব, এটা হয়। এটা হয় না, ঠিক না। (ইত্তেফাক অনলাইন)
আরেক বক্তব্যে ২০ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশন। কমিশনের প্রত্যেককে আমরা চিনি। এরা সবাই আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভালো নিয়োগ, প্রমোশন ও পোস্টিং পেয়েছেন। এরা সবাই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী।’ এতো রাজনৈতিক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি। এবার স্বীকারোক্তি তুলে ধরব সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (এফডিসি) আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) কিছুটা ত্রুটি আছে। ( ৪ জুন ২০২২)
একি বললেন কে এম নূরুল হুদা? তিনি কি হুঁশে আছেন? হুঁশে থাকলে তো এমনটা বলার কথা নয়। যে ব্যক্তি ইভিএমে ভোটের জন্য রীতিমতো লড়াই করেছেন তিনি কিনা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছুটা ত্রুটি আছে! কি সেই ত্রুটি? তার কথা- ইভিএমের ব্যালট ইউনিটকে টেকনোলজির আওতায় আনা যায়নি। এটা কমপ্লেক্সিটির জন্য। এখানেও ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। প্রশ্ন হলো এ ত্রুটি নিয়ে তিনি কীভাবে ইভিএমে একের পর এক নির্বাচন করে গেছেন। জেনে বুঝে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তার ভোট নেয়া কি বৈধ হয়েছে? আর এসব বিষয় নিয়েই সাধারণ জনগণ রীতিমত শঙ্কিত।
ইভিএম অকেজো ও অর্থ অপচয় –
অব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের অভাবে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ে থাকা (ইভিএম) ৩০ ভাগ এই মুহূর্তে অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রায় ৬৪২ কোটি টাকা মূল্যের কমপক্ষে ২৭ হাজার ৯০০টি ইভিএম যথাযথ স্টোরেজ সুবিধা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মুহূর্তে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।(দ্য ডেইলি স্টার)। অনুষ্ঠিত ইসির এক কর্মশালায় স্থিরচিত্র প্রদর্শনীতে দেখা যায় অগোছালো ও অযত্নে মেশিনগুলো রাখা হয়েছে। যেখানে ক্রয় করা মেশিনের যত্ন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে নতুন করে ইভিএম ক্রয় কার স্বার্থে? জনগণকে প্রশিক্ষণ না দিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি ইভিএমেই অটুট থাকে তাহলে বলব, সিইসি, বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব মেশিন কেনা হচ্ছে কার স্বার্থে?
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা