কুষ্টিয়া: প্রযুক্তির প্রসারের ফলে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগের মাধ্যম এখন কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত জনপদের সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। আর তাই এর অপব্যবহারে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে সাইবার অপরাধ।
গত ৪ আগস্ট কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের এক নেতা ও তার এক বান্ধবীর আপত্তিকর পর্ণো ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে শহরের এক চামড়া ব্যবসায়ীর তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের সঙ্গে কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের এক নেতার অন্তরঙ্গ ও আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ীর ওই মেয়ের দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়া প্রেম চলে আসছিল। এ নিয়ে শহরে আলোচনা-সমালোচনা হলেও আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার কাছের মানুষ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। সর্বশেষ তাদের পর্ণো ভিডিও ইন্টানেটে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাটি সবার মুখে মুখে চলে যায়।
গত ৯ মার্চ কুষ্টিয়ায় এক প্রবাসীর মেয়ে নবম শ্রেণীর স্কুলছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে ছাড়ে আজম নামে এক স্টুডিও অ্যান্ড ভিডিও দোকানের মালিক। প্রতিবেশী ইছা হকের স্ত্রী রেহানা ও তার ছেলে আজমের বন্ধু রনির সঙ্গে যোগসাজসে মেয়েটিকে রনির বাড়িতে নিয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই বাড়ির একটি কক্ষে রনির সহযোগিতায় গোপনে ক্যামেরা সেট করে ওই ছাত্রীর সঙ্গে একান্ত মুহূর্তগুলো ভিডিও করে রাখে লম্পট আজম। পরে আজম তার কম্পিউটারের মাধ্যমে বিভিন্ন মোবাইল ফোন ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন।
এর আগে গত বছরের ২২ আগস্ট কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল। তিনি উপজেলার কুর্শা ইউপির ইশিলমারী গ্রামের মৃত আলাউদ্দিনের ছেলে ও ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গোপনে ওই ভিডিওচিত্র ধারণ করে পরে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন।
একই বছরের ৩ জুলাই কুষ্টিয়ায় তিন প্রকৌশলী ও এক স্কুল শিক্ষকের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। স্কুল পড়ুয়া একাধিক মেয়ের সঙ্গে আলোচিত এসব ব্যক্তির যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও ফুটেজ মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে।
কুষ্টিয়ার মঙ্গলবাড়ীয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন পান্না মাস্টার তার বাসায় বন্ধুদের নিয়ে গোপন ক্যামেরায় এসব ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে। সে সময় কুষ্টিয়ার বেশ কয়েকজন রথি-মহারথির যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও ফুটেজও পাওয়া যায় সেখানে।
স্থানীয় যুবকরা এক ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষক হেলাল উদ্দিন পান্না মাস্টারের ছবি দেখে তাকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে ল্যাপটপ কেড়ে নিলে শিক্ষক হেলাল উদ্দিন পান্না মাস্টার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-প্রধান প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান টুটুল, মেহেরপুর এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান হাসান, গাংনী উপজেলা এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার শরিফুল ইসলাম সজল ও হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম মনোর যৌন কেলেঙ্কারির আলোচিত এসব ভিডিও ফুটেজ বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের মাত্রা। সাইবার অপরাধীরা অপরাধ ঘটানোর বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে।
মোবাইলে অশ্লীল বার্তা প্রেরণ, ফটোশপের মাধ্যমে একজনের মুখের ছবিতে অন্যের আপত্তিকর ছবি জুড়ে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মেয়েদের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের মানসিকভাবে বিব্রত করা হচ্ছে।
এসব অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তি, সংবাদকর্মী, রাজনীতিবিদসহ অনেক ব্যক্তির নামেই ফেইসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগ রয়েছে।
জেলার সাইবার অপরাধে বেশিরভাগ শিকার হচ্ছেন মেয়েরা। বখাটেরা মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুক আইডিতে অশ্লীল ছবি ও মন্তব্য পোস্ট করে হয়রানির করার চেষ্ঠা করে। অনেকেই পড়াশোনায় সময় না দিয়ে রাত জেগে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে নতুন প্রজন্মের ওপর।
কুষ্টিয়া নজরুল একাডেমির সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুর রশীদ চৌধুরী বাংলামেইলকে বলেন, ‘উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার এখন রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে অনেক অভিভাবকের ধারণা না থাকায় তাদের সন্তানরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সাইবার অপরাধের মতো নীরব সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে। যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।’