প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে প্রায় সবকিছুই। আর তা থেকে বাদ পড়ছে না বাংলাদেশের রাস্তার অন্যতম বাহন রিকশাও। এর আগে রাজধানীর সহ বেশ কিছু জেলা শহরের রাস্তায় ব্যাটারী চালিত রিকশা দেখা গেলেও এবার আসছে সৌরশক্তি চালিত রিকশা।
রিকশাচালকদের সুবিধা এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. এম শামীম কায়ছার ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রভাষক আবু রায়হান মোঃ সিদ্দিক সরকারি অনুদানে উদ্ভাবন করেছেন মাইক্রোকন্ট্রোলার সিস্টেম সৌরশক্তিচালিত রিকশা।
সৌরশক্তি চালিত এই রিকশার হুডের উপরে থাকা সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করবে। বিদ্যুৎ প্রথমে ব্যাটারিতে জমা হবে, পরে প্রয়োজন অনুসারে রিকশা চালাতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের রাস্তার ইতিমধ্যেই চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। কিন্তু এ রিকশা একদিকে যেমন বিদ্যুতের অপচয় করে, অন্যদিকে গতি নিয়ন্ত্রকও নেই। এ অবস্থার স্থায়ী সমাধানের জন্য ড. শামীম কায়ছার মাইক্রোকন্ট্রোলার সিস্টেম সৌরশক্তিচালিত রিকশা বানানোর পরিকল্পনা নেন।
তাদের উদ্ভাবিত এই রিকশা সম্বন্ধে ড. শামীম কায়ছার বলেন, এ রিকশায় শক্তি সরবরাহ করবে দুটি সৌর প্যানেল। এগুলো থাকবে রিকশার হুডের ওপর। সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্যালেন দুটি সে শক্তি সরবরাহ করবে ব্যাটারিতে। এ শক্তি রিকশা চালাতে সহযোগিতা করবে।
তিনি আরও জানান, আমাদের দেশে গরমকালে গড়ে ৮.০৩ পরিমাণ সৌরশক্তি থাকে; শীতকালে ৫.০৫। সারা বছরের হিসাবে আমরা প্রতিদিন গড়ে ৬.০৮ সৌরশক্তি পেয়ে থাকি। এ প্রাকৃতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে রিকশা চালাতে পারলে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।
আর এবিষয়ে রায়হান সিদ্দিক বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত সৌরশক্তিচালিত রিকশায় মাইক্রোকন্ট্রোলার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে শক্তি সঞ্চয়সহ অনেক কিছুই করা সম্ভব। এটিই হচ্ছে আমাদের নতুনত্ব। মাইক্রোকন্ট্রোলারের মাধ্যমে মোটরের এনার্জি ইনপুট নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাটারি চার্জের স্থায়িত্ব আরও বাড়ানো সম্ভব। এ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ব্যাটারির কার্যকারিতা ও সময় বাড়িয়ে দেবে। একটি নির্দিষ্ট গতি ওঠার পর ব্যাটারি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে আবার গতি স্বাভাবিকে ফিরে এলে ব্যাটারি বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করবে।
তিনি বললেন, ‘যখন রিকশায় যাত্রী থাকেন না, তখন এ মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা যাবে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোটর থেকে ব্যাটারিতে শক্তি সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এতে রিকশার গতি কমে যাবে, আর সৌরশক্তি ঠিকই সঞ্চিত থাকবে। শক্তি সরবরাহ কখন চালু বা বন্ধ হচ্ছে, চালক সেটি বুঝতেও পারবেন না। মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে রিকশার একটা নির্দিষ্ট গতিও নির্ধারণ করে দেয়া যায়। এতে চালক ইচ্ছা করলেও বেশি গতি তুলতে পারবেন না।’ তখন হয়তো টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও চালানো যাবে। এখন সৌরশক্তিচালিত রিকশাগুলো চার্জের পর টানা সাত থেকে আট ঘণ্টা চলে।
তারা আরো জানান, এই রিকশার কাঠামো ও গতি অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়েছে চাকা ও আধুনিক ব্রেক, যা দুর্ঘটনা এড়াতে সহায়তা করবে।
মাইক্রোকন্ট্রোলার সিস্টেম সৌরশক্তিচালিত রিকশা উদ্ভাবনের প্রধান গবেষক ড. শামীম কায়ছার জানান, রিকশাচালকদের ওপর একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, একজন রিকশাচালক প্রতিদিন গড়ে আট থেকে নয় ঘণ্টা রিকশা চালান। তাতে একেকজন রিকশাচালকের প্রতি মিনিটে শক্তি খরচ হয় গড়ে ২৩ থেকে ২৬ কিলো জুল। টানা ১০ বছর রিকশা চালানোর ফলে বেশিরভাগ চালকের ডিএনএ গঠন ভেঙে পড়ে, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। চালকদের এ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার কথা মাথায় রেখে সহজ এবং পরিবেশবান্ধব রিকশা তৈরির প্রকল্প তিনি হাতে নেন।
ড. শামীম কায়ছার জানান, এরইমধ্যে প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেয়া হয়েছে। আগামীকাল ৭ তারিখ সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে তাদের উদ্ভাবিত রিকশা নিয়ে একটি উপস্থাপনা রয়েছে। এরপর জানা যাবে কবে নাগাদ এ রিকশা বাজারে আসবে। তবে এরই মধ্যে সিলেটের একটি কোম্পানি ও চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী এ রিকশা তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামের নানাভাবে সহযোগিতার কথাও স্মরণ করেন।