বাংলাদেশের আইসিটি খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কাজ করছে শীর্ষ তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ আইটি লিমিটেড। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানিসহ বেশকিছু দেশের সঙ্গে কাজ করছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণসহ উন্নয়নমূলক কাজ করছে ক্রিয়েটিভ আইটি। দেশের ফ্রিল্যান্সিং কমিউনিটিতেও ভূমিকা রাখছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি ক্রিয়েটিভ আইটি প্রতিষ্ঠানের অফিসে তথ্যপ্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয়ে বিবার্তা২৪.নেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজের সঙ্গে কথা বলেন ক্রিয়েটিভ আইটির চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন।
বিবার্তা২৪.নেটঃ আমাদের জীবনে আইসিটির প্রভাব নিয়ে বলুন।
মনির হোসেনঃ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আমরা সবাই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছি। এর বিকল্প ভাবার আমাদের কোন জায়গা নেই। যেমন ৫ বছর আগেও তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে মেইল করাটা এত জোড়াল ছিল না। এখন কিন্তু প্র্রতিটা মুহূর্তেই আমরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছি। সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুক, ই-মেইল, স্কাইপি, অনলাইন শপিং, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ই-ব্যাংকিং, ই-শিক্ষা, ই-স্বাস্থ্য, পরিবহনের সব খাতে, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, সরকারি সব অফিস আদালতে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা চালু হয়েছে।
আর বেশি দিন বাকি নেই যখন আমাদের সব ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হবে। কাগজ, কলমের ব্যবহার দেশ থেকে উঠে যাবে। কারণ আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে তথ্যের আদানপ্রদানে, যোগাযোগ, চিত্তবিনোদন, মার্কেটিং, শিক্ষা সব ক্ষেত্রেই রয়েছে প্রযুক্তি। শপিংয়ের জন্য এখন শপিং মলে যেতে হচ্ছে না। অনলাইনে ঘরে বসেই শপিং করা যাচ্ছে। বিনোদনের জন্য এখন টেলিভিশন দেখতে হচ্ছে না। মোবাইলে সব কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সব কিছুই হাতের মুঠোয় চলে আসছে।
বিবার্তা২৪.নেট : আইসিটি সেক্টরে কী কী সমস্যা রয়েছে? এসব সমস্যার সমাধান কী?
মনির হোসেনঃ আমাদের দেশে আইসিটি সেক্টরে দক্ষ লোকের অভাব। আমরা দেশের তথ্য প্রযুক্তির সমস্ত কাজ করছি। আবার বিদেশ থেকেও কাজ এনে সেগুলো করছি। এই কাজগুলো করার জন্য যথেষ্ঠ দক্ষ জনবল নেই।
আরেকটি সমস্যা হলো আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তনের অভাব। আমাদের দেশে অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী রয়েছেন। কিন্তু অনেকেই আইসিটি বিষয়ে আগ্রহী নন। আইসিটিতে দক্ষ মানুষের প্রয়োজন।বেশিরভাগ চলে যায় ডাক্তার, উকিল, পাইলট হওয়ার জন্য।
শিক্ষার কারিকুলামে পরিবর্তন করে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ বাংলাদেশে আইসিটিভিত্তিক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কেমন?
মনির হোসেনঃ বাংলাদেশে আইসিটিভিত্তিক কর্মসংস্থানের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আইসিটির দিক থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বড় বড় প্রতিষ্ঠান আজ বাংলাদেশকে তাদের পছন্দের তালিকায় স্থান দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন ব্যবসার জন্য সবচেয়ে সমম্ভাবনায় একটি দেশ। এখানে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুয়োগ রয়েছে। নিজেকে আত্মনির্ভশীল করার ক্ষেত্র রয়েছে এখানে।
আমরা কিন্তু ডেমোগ্রাফি বনাসে আছি। ডেমোগ্রাফি বনাস হলো যখন একটা দেশের ৪০% মানুষ তরুণ হয় যাদের বয়স হয় ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। এই বয়সের মানুষের মধ্যে সৃজনশীল কাজ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আরও ২০ বছর পরে আমরা ৬০% গিয়ে দাঁড়াবো। আর এই মানুষগুলো যদি প্রযুক্তি জ্ঞানে দক্ষ হয় তাহলে তারা সারাবিশ্ব প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
দেশে কাজ আছে অনেক কিন্তু দক্ষ মানুষের অভাব। শুধু দেশে নয় সারাবিশ্বে কাজ আছে। কিন্তু সেই কাজগুলো করার জন্য দরকার উপযুক্ত প্রযুক্তি শিক্ষা। একজন সব বিষয় জানে কিন্তু বিশেষ কোন কিছুই সে জানে না। এমন শিক্ষা হলে আবার হবে না। তাই এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যেহেতু সব ক্ষেত্রে এখন প্রযুক্তিনির্ভর করা হচ্ছে তাই কাজ করার জন্য সুযোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। আগে ছিল ম্যানুয়েল পদ্ধতিনির্ভর এখন হচ্ছে সব প্রযুক্তিনির্ভর। তাহলে আমরা বলতে পারি বাংলাদেশে আইসিটিভিত্তিক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা অত্যন্ত ভাল।
প্রযুক্তি যত ব্যবহার ও প্রসার হবে এগুলো পরিচালনার জন্য তত লোকের দরকার হবে। আর এই লোকগুলোকে আইটি জ্ঞানে দক্ষ হতে হবে। এভাবে গড়ে ওঠবে দেশের দক্ষ মানব সম্পদ।
বিবার্তা২৪.নেটঃ দেশের আইসিটি কর্মসংস্থান বিকাশে কী কী সমস্যা রয়েছে?
মনির হোসেনঃ আমাদের দেশের মানুষ অনেক কিছু না বুঝেই করে। এটাই একটা বড় ধরণের সমস্যা। এই জগত নিয়ে তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই তাদের কাছে। অনেকে মনে করেন কম্পিউটার জানলেই অনলাইনে কাজ করতে পারব। আউটসোর্সিং কাজ করতে পারব।
এ বিষয়ে এখনও তেমন সচেতনতা বৃদ্ধি হয় নাই। দেশের আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো যদি সঠিক গাইডলাইন না দেয়, তাহলে যারা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে তারা আইসিটির প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে।
আর এভাবে প্রতারণার শিকার হলে তাদের মনের মধ্যে আইসিটি বিষয়ে ভুল ধারণা জন্ম নেবে। তারা আইসিটি নিয়ে কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাই প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দেয়াও একটা বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ। কারণ ভুল শিক্ষা দিলে সে শিক্ষার প্রভাব গোটা আইসিটি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন।
মনির হোসেনঃ এই সমস্যা সমাধান করা কারো একার পক্ষে সম্ভব না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আমরা যারা আইসিটি সেক্টরে কাজ করছি আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে শিগগিরই এর সমাধান সম্ভব হবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ সরকার দেশের সব সেক্টরকে আইসিটি নির্ভর করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কতটা সফল হয়েছে বলে মনে করেন।
মনির হোসেনঃ আমি বলব বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আইসিটিনির্ভর করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সফলও হচ্ছেন। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে আগামী ৩ বছরের মধ্যে ১০ লাখ তরুণ-তরুণীকে আইসিটিতে দক্ষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
এছাড়াও গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে সেখান থেকে গ্রামের মানুষকে সরকারি সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ের সরকারি অফিসসহ উপজেলা স্তরের অফিসগুলোর ডিজিটাল করা হচ্ছে।
জেলায় ডিজিটাল পদ্ধতির সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গড়ে উঠেছে কম্পিউটার ল্যাব ও ডিজিটাল ক্লাসরুম। তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল কনটেন্টস। অন্তত ৩০ হাজার দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার কর্মসূচি হাতে নিয়ে সফটওয়্যার পার্ক, হাইটেক পার্ক ও ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং-এর ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি মোবাইলভিত্তিক সেবার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের আইসিটি জ্ঞানে দক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল করতে অন্তরায় কি?
মনির হোসেনঃ বর্তমানে রাজধানীর চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠছে আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বেশিরভাগই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যে সমস্ত তরুণ-তরুণীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের মনে আইসিটির প্রতি ভুল ধারণা জন্ম নিচ্ছে। আর একটি বিষয় হলো আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজিতে দুর্বল। এই সেক্টরে কাজ করতে হলে ইংরেজির ওপর ভাল দখল থাকতে হবে। ক্লাইন্টের সাথে কমিউনিকেশন করতে হলে ইংরেজির বিকল্প নেই।
বিবার্তা২৪.নেটঃ এই অন্তরায়সমূহ দূর করার উপায় কী?
মনির হোসেনঃ এই সমস্যা দূর করতে সরকার একটু নজর দিলেই অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে। যেমন- যে সমস্ত আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু করবে সেগুলোকে অনুমোদন দেয়ার আগে একটু ভালভাবে যাচাই করে দেখে দিলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী কী কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কি বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে কোনরকম বা অল্প কাজ জানা ব্যক্তিরা কখনোই এখানে তাদের ক্যারিয়ারকে দীর্ঘ করতে পারবে না।
বিবার্তা২৪.নেটঃ দেশের আইসিটি ব্যবস্থাকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
মনির হোসেনঃ স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলাম এই ক্রিয়েটিভ আইটি প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৮ সাল থেকে আমরা এখানে ১২হাজার তরুণ-তরুণীকে ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা এখন বাইরে কাজ করছেন। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের গড়ে ১০০ জনের মধ্যে ৮০জন আইসিটি দক্ষ হচ্ছেন। ২০ জন্য সফলভাবে আউটসোর্সিং -এর কাজ করে যাচ্ছেন। বাকি ৬০ জন সফল হতে পারছেন না। কারণ এই পেশায় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়।
যেমন-প্রজেক্টে বিড করা, কাজের মূল্য ও সময় নির্ধারণ করা, যোগাযোগ রক্ষা করা, কাজের মান ঠিক রেখে সঠিক সময় সঠিক কাজটি ডেলিভারি দেয়া, বায়ারকে সন্তুষ্ট করা-প্রতিটি ক্ষেত্রই একেকটা চ্যালেঞ্জ। আর এসমস্ত কারণে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দেন। হতাশ হন। আমার পরিকল্পনা হলো এই ৬০ জনকে আমি কাজ করতে দিব। আমি বাইরে থেকে কাজের অর্ডার এনে তাদের কাজ দিব। তাদের তৈরি পণ্যগুলো আমার মার্কেটে বিক্রি করব। এ জন্য আমি একটা রিসেলাবল মার্কেট প্লেস শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছি। শিগগিরই বাজারে আসছে সেটা।
বিবার্তা২৪.নেট