প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নিজেই সিল মারছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মোবাশ্বের চৌধুরী। দরজা বন্ধ করে একটানা তিন ঘণ্টা সিল মারেন তিনি ও তার লোকজন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এমনকি এক নারীকে লাঞ্ছিত করেছেন ওই কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জানিয়েছেন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ভোটের আগেই বাক্স ভরে রেখেছিলেন এ প্রার্থী। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মোবাশ্বের চৌধুরী। কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের। প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে উত্তরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ছাড়া উত্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও কাউন্সিলরদের এজেন্ট ছাড়া অন্যদের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্যরা ঢুকতেই পারেননি মিরপুরের রূপনগরের ঊষা বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্রে। সকাল পৌনে ৮টায় ওই কেন্দ্রে ঢুকতে গেলে হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়া হয় তাদের। তাদের মধ্যে কয়েকজন এজেন্টকে মারধরও করা হয়েছে। এজেন্টদের বের করে দেয়ার সংবাদ পেয়ে কেন্দ্রে ছুটে যান কাউন্সিলর প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির নেতা শেখ নাসির উদ্দিন ও তার স্ত্রী জাকিয়া শিল্পী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় নাসির উদ্দিনকে লাঞ্ছিত করে কাউন্সিলর প্রার্থী মোবাশ্বের চৌধুরীর লোকজন। প্রতিবাদ করায় তার স্ত্রী শিল্পীকেও লাঞ্ছিত করা হয়। এমনকি শিল্পীর বস্ত্রহরণের চেষ্টাও করে ওই প্রার্থীর লোকজন। পরে দরজা বন্ধ করে মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকের টেবিল ঘড়ি ও নিজ প্রতীক রেডিওতে সিল মারেন তিনি ও তার লোকজন। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ওই কেন্দ্রে ছুটে গেলে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা। এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ফারুকুজ্জামান। এজেন্টদের বের করে দেয়া ও লাঞ্ছনার বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ নাসির উদ্দিন জানান, তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে কোথাও কোন অভিযোগ করলে তাকে হত্যা করা হবে।
একইভাবে ওই কাউন্সিলর প্রার্থী ও এ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সোবহান অভিযোগ করেন, রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরে রেখেছিল মোবাশ্বের চৌধুরীর লোকজন। নির্বাচন চলাকালে ওয়ার্ডের ৩৪ কেন্দ্রের কোথাও তার এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি মোবাশ্বেরের লোকজন। র্যাব, পুলিশ সবার কাছেই অভিযোগ করেছেন তিনি। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেননি। এমনকি প্রিজাইডিং অফিসাররা তাকে বলেছেন, আমরা অসহায়। কিছুই করতে পারবো না। ঊষা বিদ্যানিকেতন কেন্দ্রের দরজা বন্ধ রাখার একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হট্টগোল হয় ভোটারদের। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট নার্গিস মোরশেদ ওই কেন্দ্রে গেলে দরজা খুলে দেয়া হয়। ওই ওয়ার্ডের চম্পা পারুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে সকাল ৮টায় এক তরুণীকে লাঞ্ছিত করে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই তরুণী মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের এজেন্ট। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী স্বপ্না আহমেদ অভিযোগ করেন, মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। তারা মেয়েদের বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেছেন। সকাল থেকেই উল্লেখযোগ্য ভোটার ছিলেন না কোন কেন্দ্রেই। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে উত্তরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের তেজগাঁও সরকারি কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই কেন্দ্রের চারদিকে সাঁটানো ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ব্যানার-পোস্টার। কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ভিড় ছিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। সকাল ৯টা পর্যন্ত একই অবস্থা ছিল ওই কেন্দ্রে। বিভিন্ন বুথে গিয়ে দেখা গেছে ভোট প্রয়োগ হয়েছে কোথাও ১২টি, কোথাও ১৫টি। সকাল ১১টার পরেই বদলে যায় ওই কেন্দ্রের দৃশ্য। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের
সহযোগিতায় টেবিল ঘড়ি ও লাটিম প্রতীকে সিল মেরে দ্রুত ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বেলা দেড়টায় ওই কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় ১০৫ নম্বর বুথের ব্যালট বাক্সে বারবার ব্যালট ঢোকাচ্ছেন তিনজন তরুণ। একজন তরুণ তাকে সিল মেরে সহযোগিতা করছেন। আরও একজন তরুণ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী দিপু। এ বিষয়ে সহকারী প্রিজাডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, তিনি দুপুরের খাবার খেতে বাইরে গেছেন। ওই কেন্দ্রের কোন বুথেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টকে পাওয়া যায়নি। ওই ওয়ার্ডের রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়েও ছিল একই অবস্থা। সেখানেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের কোন এজেন্টকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসার আক্কাছ আলী শেখ জানান, বিএনপি কোন এজেন্ট দেয়নি। যে কারণে কোন এজেন্ট নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা থাকার কারণে তিনি গণসংযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খানের লোকজন তাকে কোথাও কোন পোস্টারও লাগাতে দেননি। এমনকি আনোয়ারুজ্জামানের কর্মী, সমর্থকদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফরিদুর রহমান খানের লোকজন। যে কারণে আতঙ্কে এজেন্টরা কেন্দ্রে যাননি। অনেককে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
উত্তরের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তেজগাঁও মহিলা কলেজে সকাল থেকেই নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ছিল তাদের সরব উপস্থিতি। এ দুটি কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে ফিরে যান অনেকে। তাদের একজন জহিরুল ইসলাম জানান, টেবিল ঘড়ি ও মিষ্টিকুমড়া মার্কার লোকদের কাছ থেকে টুকেন না নিলে ঢুকতেই দেয় না। এজন্য ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছি। সকাল ১১টার পর প্রায় ভোটার শূন্য হয়ে যায় এসব কেন্দ্র। বেলা ১১টায় উত্তরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দারুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বাইরে পুলিশ-আনসার ছাড়া কেউ নেই। ভোট দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তিন নারী। ওই তিনটি কেন্দ্রে ভোটার রয়েছেন ৬ হাজার ৪৩৬। ওই সময় পর্যন্ত ভোট প্রয়োগ হয় ৩৩০টি। ওই তিনটি কেন্দ্র নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন প্রিজাইডিং অফিসাররা। তিনটি কেন্দ্রের দুটিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদেও কোন এজেন্ট ছিল না। একটি কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের দুজন এজেন্ট ছিলেন। অন্যান্য ওয়ার্ডের মতোই ওই ওয়ার্ডের মিরপুরের হজরত শাহ আলী মডেল হাইস্কুলের কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, মাহী বি চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল কাফী, জুনায়েদ আবদুর রহিম সাকি ও নাদের চৌধুরীর কোন এজেন্ট পাওয়া যায়নি। তবে ওই ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাসুদ খানের এজেন্ট ছিলেন।
Prev Post
Next Post