বিমানবন্দর-জয়দেবপুর সড়কের দুর্ভোগ>> ভুলে ভরা বিআরটি প্রকল্প

ভুল জায়গায় ভুল নকশায় ভুলভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সুফল মিলবে না : ড. হাদিউজ্জামান * জলে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা

0

যে কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রাক-সমীক্ষা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। প্রকল্প অনুমোদনের আগে বিস্তারিত নকশা, অর্থের জোগান নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তা মানেনি। পাশাপাশি চুক্তির নানা শর্ত অমান্য করলেও সেসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোনো শাস্তিও দিতে পারেনি। উল্টো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সমীহ করে চলতে হচ্ছে। এসব কারণে নগরবাসীকে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ভুলে ভরা প্রকল্পের খেসারত আর কতদিন দিতে হবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। তবে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যস্ততম বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটারের এই করিডরটি বিআরটি প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত না হলেও সেখানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। সরকার অর্থনৈতিক, জনদুর্ভোগ ও যোগাযোগ উপযোগিতা বিবেচনা না করেই ভুল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও পদে পদে ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। এ কারণে ৪ বছরের প্রকল্প বাস্তবায়নে কেটে গেছে ১০ বছর। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্প চালুর ঘোষণা দিলেও নতুন করে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষায়িত বাস চালুসহ অন্যান্য কার্যক্রম কবে শেষ হবে তাও অনিশ্চিত। এ প্রকল্প থেকে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবে না।

জানা যায়, ২০১৮ সালের শুরুতে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিআরটি প্রকল্পের কারণে বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর সড়কে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার রাজধানীবাসী। ঢিমেতালে চলা কাজের কারণে রাজধানীর ব্যস্ততম এই সড়কে চলাচলকারী লাখো মানুষ নিত্যদিন অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে চলেছে। কোনো কোনো দিন ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগছে। অভিজাত আবাসিক এলাকা উত্তরা, শিল্প জোন গাজীপুরসহ ৩২ জেলার লাখো মানুষ নিত্যদিন চলাচলে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বিমানবন্দর-জয়দেবপুর করিডরে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে।

ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন-কবে নাগাদ শেষ হবে বিআরটি প্রকল্পের কাজ? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব মিলছে না। ঢাকা বিআরটি কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময়ে কাজ শেষের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সড়কের মূল কাজ শেষ করার কথা বলছেন। যদিও বাস্তবে সেটা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর করিডরটি বিআরটি প্রকল্প করার জন্য কোনোভাবেই উপযোগী ছিল না। ২০০৫ সালের বাস্তবতায় ওই সড়কে বিআরটির প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০১২ সালে ওই প্রকল্প অনুমোদনের আগে অর্থনৈতিক, যোগাযোগ, দুর্ভোগ এবং সুফল কী হবে-এসব উপযোগিতা বিবেচনা করে গ্রহণ করা দরকার ছিল। এক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। ভুল জায়গায় ভুল নকশায় ভুলভাবে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্প থেকে সুফল মিলবে না। বিশেষায়িত বাস ক্রয় এবং তা চালু করার বিষয়টিও অনিশ্চিত। বলা চলে বিআরটি একটি অবকাঠামো প্রকল্প হয়েছে। সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। পুরো টাকাটাই কার্যত জলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নকারীদের ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিআরটি কোম্পানি। পাশাপাশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরও বড় দায় রয়েছে। জনগণের টাকায় এত বড় ব্যর্থ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নকারীদের ব্যর্থতা চিহ্নিত করা দরকার। একই সঙ্গে দায়ীদের শাস্তিও চিহ্নিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, বিআরটি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাক-সমীক্ষা এড়িয়ে যাওয়া বড় ভুল হয়েছে। এই সমীক্ষা হলে অর্থনৈতিক, ট্রাফিক উপযোগিতা বিবেচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করা যেত; তাহলে হয়তো এ প্রকল্প হতো না। কেননা এই ব্যস্ততম সড়কে এ ধরনের প্রকল্প কোনো বিবেচনায় যৌক্তিক নয়।

তিনি বলেন, আমরা বিআরটি কোম্পানির সঙ্গে বিআরটি প্রকল্পের প্রাক-সমীক্ষা সম্পর্কে জানতে সমীক্ষা প্রতিবেদন চাইলেও সেটা তারা আমাদের দিতে পারেনি। ভুল প্রক্রিয়ায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়ও পদে পদে ভুল করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জনগণের দুর্ভোগকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এটা হতে পারে না। ব্যস্ততম একটি সড়কে বছরের পর বছর এমন দুর্ভোগ চলতে পারে না। মন্ত্রী হিসাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীরও বড় ব্যর্থতা এখানে ফুটে ওঠে। সবাইকে এ দায় নিতে হবে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, প্রাক-সমীক্ষা ছাড়া এই ধরনের প্রকল্প অনুমোদন হয় না। বিআরটি প্রকল্পের প্রাক-সমীক্ষা হয়নি বলে যারা বলছেন, তারা সঠিক বলছেন না। সব ধরনের উপযোগিতা বিবেচনা করেই বিআরটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যস্ততম সড়কে উন্নয়ন কাজ চলায় কিছুটা দুর্ভোগ হচ্ছে, আগামী এপ্রিলের পর আর এমন দুর্ভোগ থাকবে না।

তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্প ২০১২ সালে অনুমোদন পেয়েছে, এটা সত্য। তবে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। কিন্তু সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে, ২০১২ সালে কাজ শুরু হয়েছে। এমন তথ্য প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কোনো মানে হয় না। প্রকল্প এলাকায় দুর্ভোগ হওয়ায় এত সংবাদ হচ্ছে-সেটা আমরা বুঝতে পারছি। তবে দুর্ভোগ তো শুধু এই প্রকল্পের কারণে হচ্ছে না।

ওই সড়কে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল বাস্তবায়ন হচ্ছে। সব ধরনের চাপ পড়ছে। আর দীর্ঘসময় লাগার কারণ হচ্ছে, ব্যস্ততম সড়ক হওয়ায় ছুটির দিন ছাড়া কাজ করা যাচ্ছে না। দ্রুত কাজ শুরুর তাগিদ থেকে মাঝে মধ্যে আমাদের না জানিয়েও ঠিকাদার কর্মব্যস্ত দিনে কাজ করেন। তখন প্রচণ্ড যানজট হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করে প্রকল্পের আজ এগিয়ে নিতে হবে। আর কয়েকটা মাস পর ওই সড়কে কোনো দুর্ভোগ থাকবে না।

তিনি বলেন, আগামী জানুয়ারিতে জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের সড়কের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে। তবে প্রকল্পের আরও কিছু কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, বিআরটি প্রকল্পের কাজ ২০১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। আর ২০১৮ সালে পুরোদমে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৮২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি। বাকি ১৮ ভাগ কাজ কবে শেষ হবে তা অজানা রয়ে গেছে। ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।

মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হলেও এ সড়কের কারণে মানুষের দুর্ভোগ শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে অতিবর্ষণে বিআরটি প্রকল্প এলাকায় দুর্ভোগ মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিমানবন্দর, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর এবং গাজীপুরের সড়কগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। ভোর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে কার্যত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জয়দেবপুর, টঙ্গী থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়।

অল্প সময়ের ব্যবধানে যার প্রভাব পড়ে পুরো ঢাকায়। নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে তিন থেকে ১০ গুণ সময় লেগেছে কর্মব্যস্ত নগরবাসীর। বিআরটি প্রকল্পের কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সড়কে খানাখন্দ ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলেও সেদিকে বাস্তবায়নকারীদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More