রাজধানীর মহাখালী থেকে গুলশান-১। সেখানে যাওয়ার পথে হাতের ডানে লোহার ফটক। সেই ফটকে লাল রঙের ওপর সাদা কালিতে ইংরেজি হরফে বড় করে লেখা ‘পারটেক্স গ্রুপ’। পাশেই চোখে পড়বে একটি লেক। এটি গুলশান লেক। গ্রুপের অফিসের পেছনের দিকেও এখনো রয়েছে লেকের চিহ্ন।
অফিসের চারপাশে ঘুরে দেখা যায়, কৌশলে ভরাট করে লেক দখল করছে পারটেক্স গ্রুপ। বাঁশের খুঁটি পুঁতে, গাছ লাগিয়ে, নার্সারি করে এবং আবর্জনা ফেলে চলছে দখল। এতে লেকের প্রস্থ ১০০ ফুটের বেশি কমে এসেছে। প্রতিনিয়ত ময়লা আবর্জনা ফেলায় লেকের পরিধি দিন দিন কমে আসছে।
গুলশান লেক এলাকার দক্ষিণ অংশে লেকের জমিতেই নির্মাণ করা হয়েছে পারটেক্স গ্রুপের কার্যালয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অনেকদিন আগেই লেকের জমি দখল প্রক্রিয়া শুরু করে পারটেক্স গ্রুপ। তাদের সমর্থন দিচ্ছে সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা। মূল সড়কের পাশে লেক দখল করে পারটেক্সের ছত্রচ্ছায়ায় একটি নার্সারিও করা হয়েছে।
সাইনবোর্ডে নাম লেখা ‘লিজা এ নার্সারি’। কর্মচারীরা কেউ এর মালিকের নাম বলতে চাননি। পারটেক্স গ্রপের লোকজন ওই এলাকা পাহারা দেন। অনুমতি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কৌশলে ওই এলাকায় প্রবেশ করে ছবি তোলা হয়। এক পর্য়ায়ে বিষয়টি জেনে ফেললে কিছু লোক প্রতিবেদককে ধাওয়া দেয়।
মহাখালি থেকে গুলশান-১ এর লেকের চারপাশে দিন দিন বাড়ছে দখলের মাত্রা। যেভাবেই পাচ্ছে সেভাবেই গুলশান লেকটি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে পারটেক্স গ্রুপ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লেকের জমি দখল করে প্রথমে একের পর এক বস্তি ঘর গড়ে ওঠে। জমি দখলে এলেই বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মিত হয়।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কড়াইল বস্তির পাশে যে গ্যারেজ গড়ে উঠেছে তা লেকের সীমানায়। লেকের জমি দখল করে তাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে তাতে মাটি ভরাট করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
জানা যায়, রাজধানীর লেকগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। এ দুটি সংস্থাকে সহযোগিতা করে থাকে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, ওয়াসাসহ নগরভিত্তিক সেবা সংস্থাগুলো।
গুলশান লেক এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংস্থাগুলো কেউই সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের উদাসীনতার কারণে দখল ও দূষণে বিপন্ন হতে চলেছে লেকটি। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার চরম উদাসীনতায় উত্তরা লেকটির অবস্থা আজ বিপন্ন। ময়লা-আবর্জনা আর বর্জ্যে লেকটির পানি বিবর্ণ, দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী মহল দফায় দফায় নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে জমি।
তারা বলেন, আন্দোলন করলেও প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের হাত থেকে লেকটি রক্ষা করা যাচ্ছে না।
রাজউকের লেক বিষয়ক সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে গুলশান-বনানী লেকের সাউথ এভিনিউ সংলগ্ন পারটেক্স হোল্ডিংসের পূর্ব পাশের নিচু এলাকায় পারটেক্স গ্রুপ মাটি ভরাট করায় প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর ৩৬ নং আইন লঙ্ঘন হয়। এই কারণে ওই বছরের ৩ জানুয়ারি গুলশান থানায় মামলা করেন রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার সহকারী পরিচালক (স্থাপত্য) মো. মিজানুর রহমান। মামলায় আসামি করা হয়েছে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমকে। পরে পারটেক্স গ্রুপকে অবৈধভাবে ভরাট করা মাটি অপসারণ করতে বলা হলেও তা করেনি গ্রুপটি। এরই মধ্যে আবারো পারটেক্স গ্রুপ নতুনভাবে লেক ভরাট শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক-এর লেক শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলামপরিবর্তনকে বলেন, “পারটেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে আগেও একটি পরিবেশ ও জলাধার আইনে মামলা করেছে রাজউক। নতুনভাবে লেকে মাটি ভরাট করছে নাকি তা আমার জানা নেই। তবে লেক উন্নয়নে রাজউক কাজ করছে। এ জন্য একুইজিশনের কাজ চলছে। পারটেক্স গ্রুপ যদি আবারো লেক দখল করে থাকে তবে তা উচ্ছেদ করা হবে।”
তিনি বলেন, “লেক এলাকায় প্রায়ই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। যদি নতুনভাবে দখল করা হয়ে থাকে তবে তা উচ্ছেদ করা হবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা পরিবর্তনকে জানান, পারটেক্স গ্রুপ অনেক বড় প্রতিষ্ঠান হওয়াতে তাদের সাথে অনেক ভিআইপি লোকের যোগসাজশ রয়েছে। তাই রাজউক কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিলেও উপর মহলের তদবিরে তা সফল হয় না। এ জন্য বিগত ২০১০ সালে মামলা করা হলেও মামলাটির কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। এভাবেই চলতে থাকলে হয় তো একসময় হারিয়ে যাবে গুলশান লেকটি।
দখলের ব্যাপারে পারটেক্স গ্রপের পরিচালক (কর্পোরেট এফেয়ার্স) এসএম কামরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে নির্বাহী পরিচালক সুবীর কুমার ঘোষ ফোন ধরেননি।
এলাকাবাসী বলছেন, দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে লেকটি বাঁচানো সম্ভব হবে না। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে লেকের পাড়ে। আবাসিক এলাকার শত শত টয়লেটের ড্রেনেজ সরাসরি লেকের সঙ্গে সংযোগ দেওয়ায় এর পানি ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে। লেকের পানি পচে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিষাক্ত পানির কারণে মাছ মরে ভেসে উঠছে প্রায়ই।
মহাখালী গাউসুল আজম মসজিদ-সংলগ্ন লেকের অংশ থেকে বনানী ব্রিজ পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দখল-দূষণের নানা চিত্র। কড়াইল বস্তিতে লেকের ভেতর দিয়ে গ্যাস ও পানির চোরাই লাইন টানা হয়েছে। ওপর দিয়ে এলোমেলোভাবে চোরাই বিদ্যুৎ ও ডিসের লাইনের সংযোগ নেওয়া হয়েছে। লেকের পানিতে কাপড়ের টুকরা, মুরগির পাখা, কুকুর-বিড়ালের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে।
দখল প্রসঙ্গে স্থানীয়রা পরিবর্তনকে বলেন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা গুলশান লেক বাঁচিয়ে রাখতে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। করছেন সেমিনার, মানববন্ধন। কিন্তু রাজউক এসব বিষয়ে কর্ণপাত করছে না।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এভাবে চোখের সামনে লেক দখল হয়ে যাচ্ছে, আর সরকারি কর্মকর্তারা বসে বসে দেখছেন। রাজধানীতে যখন এরকম দখলদারি চলছে, তখন সারা দেশের অবস্থা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই রক্ষকেরা ভক্ষকের মতো আচরণ করে। আমরা সংশ্লিষ্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় লেকটি দূষণের কবলে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্যুয়ারেজ লাইন। লেকের দুই পাড়সহ পানিতেও ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে অহরহ। অপর পাশের লেকের জায়গা দখল করে বস্তি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী চক্র প্রতিটি ঘর থেকে মাসে এক-দেড় হাজার টাকা ভাড়া আদায় করে থাকে। বস্তির খোলা পায়খানা, মলমূত্র, নর্দমা আর লেক মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।