এই লেখা লিখছি আর ভাবছি। অনেক ভেবে চিন্তে শব্দ বসাচ্ছি। আবার কেটে দিচ্ছি। অনেক বড় একটা প্যারা লিখে ফেলে আবার মুছে দিচ্ছি। সবসময় ভয় কাজ করছে- আমাকে জেলে দেয়া হবে না তো? কিংবা হয়রানি বা গুম? সবসময় ভাবছি ভুল করে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলে ফেললাম না তো? এযেন ছোটকালে শেখা সেই কুসংস্কারের- ‘বড়দের ভুল ধরাটাও ভুল’। আজ তাই সরকারের অপরাধগুলো ধরিয়ে দেয়াও অপরাধ। বাংলাদেশের মাটিতে সম্ভাব্য সকল অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ। বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছি আর ভয় পাচ্ছি- মনের অজান্তে এই অপরাধটা করে ফেলছি না তো? পুলিশ প্রধান প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়েছেন জনগন নয় বরং পুলিশই সরকার টিকিয়ে রেখেছেন, তেরো সালের আন্দোলন দমিয়েছেন, নির্বাচন করিয়েছেন। এরকম যখন অবস্থা তখন আর কিইবা বলতে বা লিখতে পারি? পুলিশী রাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে তাই এতটুকুই বললাম। জানিনে এতটুকু বলেই গিয়েই কোন মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছি কিনা।
এক.
ফেসবুকেই খবরটা পেলাম। সবচেয়ে দ্রুত খবর পাওয়ার মাধ্যম এখন ফেসবুক। সেই সাথে উড়ো খবর আর মিথ্যারও। পরে অনলাইন পোর্টালগুলোতেও পেলাম। বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্য। ছবিগুলো দেখে খুব খারাপ লাগল। বিশেষ করে এক নারীর পেট বরাবর লাত্থি মারার দৃশ্যটা। এই পেটই একদিন সন্তান জন্ম দেবে, যিনি লাত্থি মারছেন তিনিও এরকম এক পেটেই ছিলেন। সংবাদে দেখলাম ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক লাকি আক্তারের মাথাও নাকি ফাটিয়ে ফেলা হয়েছে। অবশ্য এর কোন ছবি পেলাম না। এটিএনে উনি লাইভ প্রোগ্রাম করে গেলেন কোন ব্যান্ডেজ ছাড়া। অর্থাত, আমি যে সংবাদ শুনেছি সেটা সত্য না।
তবে এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। পুলিশ কেন হঠাত করে গৃহপালিত একটি ছাত্ররাজনৈতিক দলের উপর সহিংস হয়ে উঠল? বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছিল না। ইতিহাস সামান্যই পাঠ করেছি। তা থেকে জেনেছি কমিউনিস্ট তাজউদ্দীন, আব্দুর রবরা ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান ভাঙলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলেন সামান্যই। তাজউদ্দীনের মত লীগে অনুপ্রবেশকারী কমিউনিস্টরা কোনমতে বেঁচে গেলেও গনমানুষের কাছে পৌঁছুতে সক্ষম হওয়া জাসদ মেরে বঙ্গবন্ধু কর্মীর চেয়ে নেতা বেশী টাইপের দলে পরিনত করে ফেলেন। সেরকমই আওয়ামী লীগ আবার রাশিয়ার ব্রেইন চাইল্ডদের ওপর চড়াও হল কিনা সেটা ভাবছিলাম। তবে কি রাশান ভদকার চাহিদা এত দ্রুতই মিটে গেল!
ভুল ভাঙল একটা ছবি দেখে। ধীরে ধীরে আরো অনেকগুলো সত্য উন্মোচিত হতে থাকল। যে মহিলাকে লাত্থি মারার ছবি দেখিয়ে সহানুভূতি আদায়ের প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা, সেই মহিলাই যে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে নিরীহ হকারদের ব্যবসা সামগ্রী ছুঁড়ে মেরে উসকানী দিয়েছেন তা খুব সঙ্গোপনে চেপে যাওয়া হয়েছে!
ছাত্র ইউনিয়নের এই নেত্রীর কাছে আমার কয়েকটি জিজ্ঞাসা আছে। ম্যাডাম, এই যে টবটা আপনি ছুঁড়ে মারলেন। এটা এক দোকানির। দরিদ্র দোকানির। আপনারা তো পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন এই দরিদ্র লোকটির সামান্য পুঁজি ধ্বংস করছেন? নাকি ‘বিশাল’ এই অস্থায়ী দোকান দেখে আপনার হিংসে হচ্ছে, একেও পুঁজিবাদের সুবিধাভোগী বলে মনে হচ্ছে?
নেত্রী, আপনি যে টবটা ধ্বংস করছেন এটা মানুষের সম্পত্তি। এই সম্পত্তি ধ্বংস করার অধিকার আপনাকে কে দিল? নাকি মানুষকে নিজেদের দাস মনে করেন যে যারটা ইচ্ছা ধ্বংস করবেন আর যারটা ইচ্ছা করবেন না?
ম্যাডাম, আপনি যে গাড়িটা লক্ষ্য করে টবটা মারছেন এটা আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা। আমি বৃত্তির টাকা, ঈদের সেলামি জমিয়ে আপনাদের মুখপাত্র প্রথম আলো পত্রিকার সিস্টার কনসার্ন পিজ্জা হাট আর কেএফসিতে যাই। ১৮ টাকার পেপসির দাম ৫০ টাকা রাখেন তাতে আপত্তি করি না। এই যে মুখে শ্রেণী বৈষম্য আর সাম্যের কথা বলে কে,এফ,সি-পিজ্জা হাট-প্রথম আলোর মত পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান চালান তাতেও আপত্তি করি না। আপনাদের সাবেক নেতা, মাহফুয আনাম স্যার, বিতার্কিক হিসেবে যাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা ও সম্মান করি, তিনি যে পুঁজিবাদী ডেইলী স্টারের সম্পাদক তাতেও আপত্তি করি না। কিন্তু মোটা দাগে ১৫% ভ্যাট কেটে নেন। সেই ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায় কেনা গাড়ি ভাঙছেন আপনি। কে দিল আপনাকে এই অনুমতি? আমার কেনা চাকু দিয়ে আমারই গলা কাটছেন?
দুই.
কমিউনিস্টদের গোয়েবলসীয় প্রচার মাধ্যম আর উন্নত লেখনী-সাহিত্য দিয়ে তারা অনেক কিছুই জয় করে ফেলেছেন। আমাদের সমাজের ডানপন্থী ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন অংশটা কমিউনিস্টদের সংখ্যাতত্ত্ব সামনে এনে তাদেরকে খাটো করে দেখাতে চায়। কিন্তু এতে আখেরে কার লাভ তা আমি জানিনে। আমি এখনো কোন মুসলিম সাহিত্যিকের বই পড়ার চেয়ে রাশান লেখকদের বই বেশী পছন্দ করি। এপারের বাংলা সাহিত্যিকদের চেয়ে ওপারের সাহিত্যিকদের লেখা ভাল লাগে। এর কারন এটা না যে ওঁরা সত্য বলে, আমার ওদের ভাল লাগে কারন মিথ্যাও যে কতটা সুন্দরভাবে লেখা যায় তা ওঁনাদের লেখা না পড়লে বোঝা যাবে না। এই যে, মহিলাটি, যার ছবি দেখে আমরা কেঁদেছি, আমরা কি জানতাম যে উনি আসলে গঠনেই মহিলা? আদতে যে ওঁনার ভেতর একটা হিংস্র পশু বাস করছে? যে সবসময় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়? আমরা কিন্তু কেঁদেছি, একজন মুখোশধারীর অভিনয়ে আমরা কষ্ট পেয়েছি, কান্না করেছি। ওদের এই জিনিসটিই আমাকে মুগ্ধ করে। প্রচার কৌশলের জন্য কমিউনিস্টদের প্রতি আমার টুপিখোলা সম্মান সবসময়ই ছিল, আজও অক্ষুন্ন আছে।
ওদের প্রচার কৌশল এতটাই সুন্দর যে, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের প্রধান শত্রু জামায়াতে ইসলামীও তাদের ব্যাথায় ব্যথিত। জামায়াত খুব যে খোলামনে পুলিশী একশনের নিন্দা জানিয়েছে, কিংবা এর পেছনে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য নেই তা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এরপরও কিছু কথা থেকেই যায়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়নের পিতৃব্য সংগঠনগুলো বরাবরের বলে আসছে জামায়াত নেতৃত্বাধীন ইসলামী শক্তি সঙ্কীর্নমনা, তারা মুক্তমনা নয়, তারা ধর্মান্ধ। আমরাও সেটা বিশ্বাস করতে চাই। বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী দলের পক্ষে কেউই থাকতে চায় না। কিন্তু জন্মবিরোধীদের বিরুদ্ধ পক্ষ যখন বন্দুকযুদ্ধে সাফাই গায়, ধরে ধরে জবাই করার কথা বলে অথচ যাকে জন্মবিরোধী বলা হচ্ছে তারা সেই জবাইকারীদের উপর বিচারবহির্ভূত আক্রমনের নিন্দা জানায় তখন মানুষের সিম্প্যাথি একশ’ আশি ডিগ্রী ঘুরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আরো জানতে পারলাম যে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জেহাদ করেই ক্ষান্ত হননি, তারা প্রাইভেট কারে বসা সাধারন জনতার সাথেও শ্রেণি সংগ্রাম করেছেন। প্রাইভেট কার হচ্ছে পুঁজিবাদীদের সম্পত্তি। এখানে বড়লোকরা চড়ে। বড়লোকরা আমাদের শত্রু। তাই সম্ভবত শ্রেণি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা শ্রেণি শত্রুদের বিনাশে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিষয়টা আমাকে বরাবরই শঙ্কিত করে তোলে। ১৯৭৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের ধর্মভাই কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর সৈনিকদের খেপিয়ে তুলে অফিসারদের বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামে নিয়োজিত করে। এতে ২০ জন অফিসার মারাও যান। যদিও জিয়া তাহেরকে কোর্ট মার্শালে মেরেছে পলিটিক্যাল কারনেই, তবু তাহেরের প্রতি আমার সিম্প্যাথি নেই। যে নোংরা খেলা সে শুরু করেছিল তার পরিনতিই তাকে ভোগ করতে হয়েছে। ধর্মে অবিশ্বাসী ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এটাকে বলেন প্রকৃতির নিয়ম। আমি বলি স্রষ্টার বিচার।
আমার ভয় হয়, এরা যদি কোনদিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তাহলে আমি বাঁচবো তো? আমার বাবার গাড়ির আছে, আমরা ফ্ল্যাটে থাকি। রংপুরে আমাদের জমি-জমা আছে, নিজেদের বাড়ি আছে। আমাদের খুন করে ফেলবে না তো ওরা? আমার বাসার যে কাজের মেয়েটাকে ছোট থেকে বড় করেছে মা, আমাদেরই মত আদর করেছেন, ঈদে আমাদের মতই জামা কিনে দিয়েছেন সেই মেয়েটাকে ফুসলিয়ে তাকে দিয়েই আমাদের খুন করাবে না তো?
জামায়াত কি উদ্দেশ্যে পুলিশী একশনের নিন্দা জানিয়েছে তা আমার কাছে স্পষ্ট না। জামায়াত নিতান্তই মানবতাবোধ থেকে এটা করেছে এতটা সরলীকরন করতে আমি রাজি নই। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ছাত্র ইউনিয়ন ধরে ধরে জবাই করার শ্লোগান দিয়েছিল, ক্রসফায়ারে মারাকে সমর্থন করেছিল, নির্যাতন আর অত্যাচারকে জাস্টিফাই করেছিল। শিবিরের ছেলেরা যখন পুলিশের গুলির মুখে ককটেল বা ইট মারত কিংবা বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাঙত তখন এই ছাত্র ইউনিয়ন তার প্রচার মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করেছে। মিডিয়ায় বসে থাকা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক রথী-মহারথীরা ঝড় তুলেছেন। জামায়াত-শিবিরের ককটেলকে তারা ইরানের পরামানু কর্মসূচীর চেয়েও ভীতিকর হিসেবে প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আজ তারাই যখন আক্রান্ত হলেন তখন জামায়াত আক্রমনের নিন্দা করল। বেশী কিছু না, হয়ত এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে জামায়াত রাজাকার হোক বা না হোক, অন্তত কমিউনিস্টদের মত একচক্ষু অমানুষ না। এই যে জামায়াতের প্রতি দিন দিন মানুষের সমর্থন বাড়ছে। কি কারনে? জামায়াত অনেক ভাল কাজ করেছে? প্রতিটা মহল্লায় মসজিদ-মাদ্রাসা-স্কুল আর লাইব্রেরী তৈরী করেছে? এর কিছুই করে নাই। জামায়াতের প্রতি মানুষের সমর্থন বেড়েছে ছাত্র ইউনিয়নের মত এই অমানুষদের সংগঠনগুলোর জন্য।
দীর্ঘজীবী হোক ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি। যতদিন ছাত্র ইউনিয়ন আছে ততদিন অপরাজনীতির সংজ্ঞা জানতে অন্তত ডিকশনারী হাতাতে হবে না।
আশরাফ আজীজ ইশরাক ফাহিম
ব্লগার এবং অনলাইন এক্টিভিস্ট