অভিবাসী শ্রমিক নিয়ে ‘মিথ্যা’ তথ্য: গোটা বাজার এখন ভারত-নেপালের দখলে

0

গত কয়েক বছর ধরেই বিদেশে বিভিন্ন গন্তব্যে শ্রমিক পাঠানোর সঠিক তথ্য নিয়ে গুঞ্জন চলছিল। সরকার যে তথ্য প্রকাশ করছিল, বাস্তবে তা সঠিক নয় বলে দাবি করে আসছিলেন প্রবাসীরা। মূলত বিদেশে টাকা পাচার করে সেই টাকা দেশে আনতে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির নাটক সাজানোর কথা শোনা যাচ্ছিল প্রবাসীদের মধ্যেই। সেই গুঞ্জনই এখন কি সত্যি? এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে প্রবাসী আয়ের ধস দেখে।

প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশীদের অভিযোগ ছিলো বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশীরা চাকুরি হারিয়ে একেবারে শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু যখন তারা এমন অভিযোগ করে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ছিলো বিপরীত চিত্র। হু হু করে প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স বাড়ার গল্প ছড়িয়ে দেয়া হয় বাজারে।

বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর কাজে দীর্ঘদিন জড়িত এমন কয়েকজন এজেন্ট মালিক জানিয়েছেন, সরকার গত কয়েক বছর ধরে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির যে তথ্য দিচ্ছে তা নিয়ে তাদের প্রশ্ন ছিলো। তাদের অভিযোগ ছিলো মূলত চিকিৎসা বা ভ্রমণ ভিসা নিয়েও যারা বিদেশ যাচ্ছেন-তাদের হিসেবও ঘটা করে শ্রমিক রপ্তানির তালিকায় দেখানো হচ্ছিল।

এমন অভিযোগ আনা একজন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এই প্রতিবেদককে বলেন, গত এক দশক ধরে প্রবাসী শ্রমিক রপ্তানিতে মন্দা চলছে। বলা যায় বাংলাদেশের এই বাজার পুরোটাই এখন ভারতের দখলে। বিদেশে বাংলাদেশী মিশন ও দূতাবাসগুলোর ব্যর্থতা এবং দেশে মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ এজেন্ট মালিকের অভিযোগ।

এজেন্ট মালিক বা বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি খাতের সংশ্লিষ্টদের এই অভিযোগও সত্য বলে এখন প্রমাণিত। গত কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্স আয়ে ভাটা চলছে। এখন তা তলানিতে ঠেকেছে।

সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন ৮ লাখ ৭৪ হাজার শ্রমিক। সিংহভাগেরই গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত ও সিঙ্গাপুর। সরকারি এই হিসেবে যদি সত্য হয় তবে শ্রমিকের সংখ্যার সঙ্গে প্রধান এসব শ্রমবাজার থেকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ার কথা। কিন্তু একেবারেই বিপরীত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ শতাংশ কমেছে। সে ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশে অভিবাসী হয়েছেন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৩ বাংলাদেশী শ্রমিক। ২০২১ সালেও পাড়ি দিয়েছেন ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব ছাড়াও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোয় যারা সরকারি হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন, তার সবক’টি থেকেই কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। গত অর্থবছরে ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। একই সময়ে কুয়েত থেকে কমেছে ১০ দশমিক ৪৩, ওমান থেকে ৪১ দশমিক ৫৬ ও কাতার থেকে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স আহরণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার সিঙ্গাপুর থেকেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৩৮ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরে সেই প্রবাহ আরো বেশি নিম্নমুখী। সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। অথচ আগের মাস আগস্টেও দেশটি থেকে ৩০ কোটি ডলার এসেছিল। আমিরাতের মতোই খারাপ পরিস্থিতি ওমান থেকে আসা রেমিট্যান্সের। সেপ্টেম্বরে কেবল ৪ কোটি ডলার এসেছে, যেখানে জুলাইয়েও এসেছিল প্রায় ৮ কোটি ডলার।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেলেও সরকার বলছে, চলতি বছর ওমানে নতুন অভিবাসী হয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮১ বাংলাদেশী। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৮৩ হাজার ৬৭৪, কাতারে ১৭ হাজার ২০৪, কুয়েতে ১৩ হাজার ৫৯৯ ও সিঙ্গাপুরে ৪৮ হাজার ২২৫ বাংলাদেশী নতুন অভিবাসী হয়েছেন। সরকারের হিসেবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছেন ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৯ জন। ২০২১ সালেও শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গিয়েছিলেন ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশী।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে রেমিট্যান্স আয় নিয়ে। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন হুন্ডির কথা। তবে বিদেশে প্রবাসী এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, বাস্তবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার একেবারেই সংকোচিত হয়ে পড়েছে। এই বাজার এখন গোটাটাই ভারত ও নেপালের দখলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ডলার, যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সাম্প্রতিক সময়ে একক মাস হিসেবে এর চেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। ওই মাসে ১৪৯ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

উৎসঃ   আমার দেশ
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More