শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আবারো আলোচনায় ছাত্রলীগ। নেতাকর্মীদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ম্লান হচ্ছে সংগঠনটির ঐতিহ্য। শুধু নেতারাই নন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে নেই নেত্রীরাও। কিছুদিন আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগে রাজধানীর ইডেন কলেজে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাও বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নিপীড়ন ও অন্তঃকোন্দলে সংঘর্ষে জড়ানোর অভিযোগও সামনে এসেছে সংগঠনটির নেত্রীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কমছে না অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে এক ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগী তাবাস্সুম ইসলামের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে।
বিষয়টি পরবর্তীতে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালতের নির্দেশে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগ পৃথক কমিটি করেছে এ ঘটনায়। অভিযুক্ত নেত্রীদের ক্যাম্পাসও ছাড়তে নির্দেশনা দেন আদালত। জানা গেছে, ওইদিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন করা হয় ফুলপরী খাতুন নামে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রীকে। র্যাগিংয়ের সময় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীরা তার বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে রাখে বলে অভিযোগ ফুলপরীর। পরদিন ভয়ে হল ছাড়েন ওই ছাত্রী। এরপর শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। ছাত্রলীগ এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুইজনকে সংগঠন থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছে। তবে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরার দাবি, ওই ছাত্রীর সঙ্গে এ রকম কোনো কিছু ঘটেনি। এদিকে এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে তদন্ত কমিটিগুলো। তারা উভয়পক্ষের বক্তব্য নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এর আগে ২৪শে সেপ্টেম্বর ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ তোলায় তোপের মুখে পড়েন সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস। এ ঘটনায় রিভা-রাজিয়ার অনুসারীরা তাকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়। এর আগে ২২শে সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন অনিয়ম, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য ও হল দখল নিয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়ায় জান্নাতুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধে ক্ষেপেছেন রিভা রাজিয়ার অনুসারীরা।
পরবর্তীতে তাকে নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ। এছাড়াও কক্ষে আটকে মারধরও করা হয় বলে তিনি জানান। অভিযোগ করেন, রিভা-রাজিয়ার অনুসারীরা তার আপত্তিকর ছবি তুলেন। ওই সময় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে আত্মহত্যার হুমকি দেন জান্নাতুল ফেরদৌস। এর কিছুদিন আগে তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। যেখানে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার কারণে রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ২০২ নম্বর কক্ষের কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দেয়ার হুমকি দিতে শোনা যায় তামান্নাকে। এই অডিও ক্লিপ ফাঁস করার অভিযোগে আরও দুই ছাত্রীকে ৭ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন এবং নগ্ন করে ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকিও দেন রিভা। এদিকে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের আন্দোলন নিয়ে ২৫শে সেপ্টেম্বর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার সংবাদ সম্মেলন চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে রিভাসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। এর আগে দুপুরে আরেক সংবাদ সম্মেলন করে জান্নাতুল ফেরদৌসের অনুসারীরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দেন রিভা ও রাজিয়া। পরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে সভাপতি রিভা ও সহ-সভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈসহ অন্তত ১০জন আহত হন। এসব ঘটনায় রিভা-রাজিয়ার কমিটি স্থগিতকরণ সহ বেশক’জনকে বহিষ্কার করা হয় ছাত্রলীগ থেকে। পরবর্তীতে নিজ আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের ক্ষমাও করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গত ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শাড়ি নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বঙ্গমাতা হল ছাত্রলীগের দুইটি পক্ষ। একপর্যায়ে মারামারিতেও জড়ান তারা। ওইদিন রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে এই মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে ১০ জন আহত হয়েছেন। গত ১০ই মে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শাখা ছাত্রলীগের এক নেত্রীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলের একটি কক্ষ দখলের অভিযোগ উঠে। এর প্রতিবাদে মধ্যরাতে ওই কক্ষের আবাসিক ছাত্রীসহ প্রায় ২০জন ছাত্রী হলের বাইরে অবস্থান নেন এবং রাতভর আন্দোলন করেন। পরবর্তীতে ওই হলের প্রভোস্ট এসে কক্ষটি তালাবদ্ধ করে দেন এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের আশ্বাস দেন।
প্রভোস্টের আশ্বাসে পরে ছাত্রীরা আন্দোলন থামিয়ে নিজ নিজ কক্ষে চলে যান। বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি মানবজমিনকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আসা কাম্য না। কেউ কোনো অপরাধে জড়াবে এটি আমরা প্রত্যাশা করি না। ছাত্রলীগ এসব ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আর এটা যে শুধু ছাত্রলীগ করছে- তাও না। যারাই এসব কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে তারা অতিউৎসাহী। তিনি বলেন, আমরা চাই- জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়রদের সুসম্পর্ক থাকবে। র্যাগিং বা নিপীড়নের ঘটনা ঘটবে না। আবার কোথাও কোথাও জুনিয়ররা সিনিয়রদের ভিকটিমও করে থাকে। তাই আমাদের এসব বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সবাইকে সহনশীল হতে হবে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এন্টি র্যাগিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। আমরা মনে করি পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে এটি বন্ধ হওয়া উচিত। একইসঙ্গে এর বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনও গড়ে তোলা উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কোনো অপরাধীর ছাত্রলীগে স্থান নেই। যারাই এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কোনো অপরাধীর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ নেই।