বেপরোয়া ‘দরবেশ’ বাহিনী, জিম্মি হাজারও ব্যবসায়ী

গুলিস্তানের ৫ মার্কেটে চাঁদাবাজি: সরেজমিন অনুসন্ধান: মূল হোতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা কার্যকর হয়নি * সেকেন্ড ইন কমান্ড ওয়ার্ড কাউন্সিলর আউয়ালের নামে হুমকি-ধমকি

0

কেউ ডাকেন জিনের বাদশাহ! কেউবা ডাকেন হুজুর! আছে দরবেশ তকমাও। নানা ধরনের লেবাসের আড়ালে আসলে তিনি একজন পেশাদার দখলদার ও চাঁদাবাজ। তার গড়ে তোলা চাঁদাবাজির নতুন চক্র পরিচিতি পেয়েছে ‘দরবেশ বাহিনী’ নামে। এমন তথ্য তুলে ধরে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, বাহিনীর অন্তত দুই ডজন সদস্য চাঁদাবাজির নয়া কৌশলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলকা গুলিস্তানে। বেপরোয়া এই চাঁদাবাজচক্রের কাছে জিম্মি এখানকার পাঁচ মার্কেটের অন্তত ছয় হাজার ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আউয়ালের ওপর ভর করেই শীর্ষ সন্ত্রাসী আগা শামীমের একসময়ের ঘনিষ্ঠ গুলিস্তানের পুরোনো ত্রাস আব্দুর রহমান গড়ে তুলেছেন এই চাঁদাবাজচক্র। প্রভাব খাটিয়ে গুলিস্তানের তিন মার্কেটের পার্কিং ইজারা নেওয়ার পরই প্রসারিত হয়েছে চাঁদাবাজির পথ। নয়া কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র আবিষ্কার করে মাসে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি তারা নগর প্লাজার মালিক সমিতির অফিসও দখলে নিয়েছেন। মার্কেট পরিচালনার নামে ব্যবসায়ীদের করা হয়েছে জিম্মি।

দরবেশ বাহিনীর হোতা আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও র‌্যাব ডিজির কাছে একাধিকবার আবেদন করেছেন এক ব্যবসায়ী নেতা। তার আবেদনে যুবলীগের শীর্ষ এক নেতা এবং দুজন সংসদ-সদস্য সুপারিশও করেছেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কখনো ডিএমপি কমিশনার, কখনো উপকমিশনারকে (রমনা) লিখিত নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপরও রহস্যজনক কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছেন কালা রফিক, ওয়াজিউল্ল্যাহ হত্যাসহ অন্তত ১০ মামলার আসামি আব্দুর রহমান ওরফে হুজুর ওরফে জিনের বাদশাহ ওরফে দরবেশ। ২০০২ সালে চাঁদাবাজির সময় তাকে একবার গ্রেফতার করেছিল মতিঝিল থানা পুলিশ। যুগান্তরের সরেজমিন অনুসন্ধান, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে করা অভিযোগের নথি থেকে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ এপ্রিল যুগান্তরে ‘আতঙ্কে গুলিস্তানের তিন মার্কেটের ব্যবসায়ী : কোটি টাকা চাঁদার মিশনে তিন টেক্কা বাহিনী’ শিরোনামে খবর প্রচারের পর টনক নড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাদের তৎপরতায় আত্মগোপনের এক পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান ওই বাহিনীর সদস্যরা। তখন স্বস্তি ফিরেছিল ব্যবসায়ীদের মাঝে। এখন নতুন করে ‘দরবেশ বাহিনী’ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফের অস্বস্তি দানা বাঁধছে।

জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, ‘দরবেশ বাহিনী সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। সিটি করপোরেশন পার্কিং ইজারা দিয়েছে। এটা পছন্দ না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির কাহিনি সাজিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ আব্দুর রহমানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তাকেই জিজ্ঞাসা করেন।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে আউয়াল বলেন, ‘৩০ বছর ধরে ওরা খেয়েছে, তাতে দোষ নেই। আমি গিয়েছি তিন দিন ধরে। ওরা লোক ভালো না।’ মার্কেট সমিতির অফিস দখল ও বিদ্যুৎ বিলের নামে চাঁদা আদায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আর কথা বলতে চাননি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন যুগান্তরকে বলেন, ‘রাইতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে কার পার্কিংয়ের ইজারা দেওয়া হয়েছে। মার্কেটের বাইরে চাঁদা তোলার এখতিয়ার তাদের নেই। এ ব্যাপারে অভিযোগ এলে তদন্তে সত্যতা প্রমাণের পর ইজারা বাতিল করে দেওয়া হবে। মার্কেটের বাইরে মালামাল গাড়িতে ওঠানামার জন্য টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

সব অভিযোগ অস্বীকার করে দরবেশ বাহিনীর হোতা আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার নামে কোনো বাহিনী নেই। কাউন্সিলর আউয়াল ও আমার সাবজেক্ট এক নয়। আমি মহানগর মার্কেট নিয়ে আছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির একটি মিথ্যা মামলায় আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওয়াজিউল্ল্যাহ হত্যা মামলায় অনেক যাচাই-বাছাই শেষে আমাকে বাদ দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেয় পুলিশ। কালা রফিকের ঘটনাও সবাই জানে। আমি দুইবার মেয়র ও একবার এমপি নির্বাচন করেছি। আমার সম্পর্কে চাঁদাবাজির অভিযোগ করলে কেউ বিশ্বাস করবে না।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২-এর তিনটি বহুতল ভবন নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও জাকের সুপার মার্কেট। দেশি-বিদেশি পণ্যের পাইকারি বেচাকেনার বৃহৎ এই মার্কেট তিনটির বেইজমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা পেয়েছে রাইতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানের ‘আসল মালিক’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আউয়াল। জানা যায়, কাউন্সিলর হিসাবে করপোরেশনের ঠিকাদারি বা ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধা থাকায় যুবলীগের এক নেতার নামে ইজারা নিয়েছেন তিনি। গত বছরের নভেম্বরে ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ২৫০ টাকায় রাইতা ইন্টারন্যাশনালকে গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাড়ি পার্কিংয়ের ইজারা নেওয়ার কিছু দিন পর থেকেই কাউন্সিলর আউয়ালকে সামনে রেখে নতুন চাঁদাবাজচক্র গড়ে তোলেন আব্দুর রহমান। এমনকি গাড়ি পার্কিং ইজারার জন্য প্রায় অর্ধকোটি টাকার পুরো বিনিয়োগই করেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে মার্কেটকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির বিভিন্ন খাত আবিষ্কার করতে থাকেন। তাদের শুধু পার্কিং চার্জ হিসাবে গাড়িপ্রতি ২০ টাকা আদায়ের অনুমতি রয়েছে। এটিকে পুঁজি করেই পার্কিং ও মালামাল নিতে আসা গাড়ি থেকে ইচ্ছামতো চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটি মিনি ট্রাক মাল বোঝাই করলেও ব্যবসায়ীদের চাঁদা গুনতে হচ্ছে ৩০০-৫০০ টাকা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এ খাত থেকে মাসে চাঁদা আদায় হচ্ছে অন্তত ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া মার্কেটের সামনে ফুটপাতে বসে যারা ব্যবসা করছেন, তাদেরকে জনপ্রতি দৈনিক ১০০ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই টাকা তোলেন দরবেশ বাহিনীর সদস্য সাইফুল ইসলাম। ঢাকার বাইরে থেকে আসা দুইশ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বস্তাপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা আদায় করছেন। এ হিসাবে মাসে এ খাত থেকেই চাঁদা আসে ১৮ লাখ টাকা। চাঁদা নিয়ে ব্যবসায়ীদের যে রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো গাড়ি পার্কিয়ের জন্য তৈরি করা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁদাবাজির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এই চক্রের সদস্যরা সম্প্রতি নগর প্লাজার দোকান মালিক সমিতির অফিস কক্ষ দখলে নিয়েছেন। নেতাদের বের করে দিয়ে আলমারি ভেঙে সমিতির প্যাড, মানি রিসিট ব্যবহার করে দোকান মালিকদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক হারে বিদ্যুৎ বিল তুলছেন। বিদ্যুৎ বিল বাবদ মাসে তোলা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা। এছাড়া নগর প্লাজার পঞ্চম তলার ব্যক্তিমালিকানার ২৯টি দোকান দখলে নিয়ে ভাড়া দিয়েছে দরবেশ বাহিনী। প্রতি দোকান থেকে মাসে ভাড়া বাবদ ১৫ হাজার টাকা হারে মোট ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করছেন। মার্কেটের নিরাপত্তার নামেও মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তারা মাসে প্রায় কোটি টাকা চাঁদাবাজি করছেন বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। এক ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ বিলের কপি এ প্রতিবেদকের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘১২০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকানের জন্য আমাকে এক মাসে বিল দিতে হয়েছে ৮৯৫৯ টাকা। ইউনিটপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ১৫ টাকা ১৬ পয়সা। এছাড়া নানা ভূতুরে খাত দেখিয়ে (বিদ্যুৎ বিলের সার্ভিস চার্জ হিসাবে ১০৫ টাকা ৯০ পয়সা, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ ১০০ টাকা, ডিমান্ড চার্জ প্রতিমাসে ৩০০ টাকা ও ভ্যাট শতকরা ৫ ভাগ হিসাবে ৪২৬ টাকা ৬৬ পয়সা) টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই বিল বিদ্যুৎ অফিসের তৈরি নয়। চাঁদাবাজচক্র নিজেরা কম্পিউটারে বিল বানিয়ে মালিক সমিতির নামে আদায় করে।’

জানতে চাইলে নগর প্লাজা মালিক সমিতির সভাপতি মাসুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘দরবেশ বাহিনীর চাঁদাবাজিতে ব্যবসয়ীরা অতিষ্ঠ। সারা দিন চাঁদা কালেক্ট করে তারা ব্যাগভর্তি টাকা কাউন্সিলর আউয়াল সাহেবের অফিসে নিয়ে যান। তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা মালামাল কিনতে নগর প্লাজায় আসতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় অনেকেই নগর প্লাজা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।’

জানা যায়, এই চাঁদাবাজচক্রে মাঠ পর্যায়ে যারা সক্রিয়, তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন কাউন্সিলর আউয়ালের বন্ধু। তার সহযোগীরা হলেন রুম্মান শেখ, দিলদার, রমজান ও শাহীন। এছাড়া পুরান ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের এক ডজন সদস্য এই চক্রে জড়িয়েছে। যারা দৈনিক হাজিরায় চাঁদা তোলার কাজ করে। এদের নাম বলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, নজর প্লাজা, সিটি প্লাজায় চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে জাকের সুপার মার্কেটে ব্যবসার পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানের ১৭৯ জন ব্যবসায়ী জনপ্রতি ১৯ হাজার ৫৫৩ টাকা করে মোট ৩৫ লাখ টাকা তুলে কাউন্সিলর আউয়ালকে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর থেকে এই মার্কেটে পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ। দরবেশ বাহিনীর সদস্যরা এই তিন মার্কেট ছাড়াও সুন্দরবন সুপার মার্কেট ও মহানগর মার্কেটে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চাঁদাবাজি করছেন। সুন্দরবন মার্কেটের পার্কিংও তারা ইজারা নিয়েছেন। এছাড়া অবৈধভাবে গড়ে তোলা মহানগর মার্কেটের ৭০০ দোকানের একক দখলদার দরবেশ বাহিনীর হোতা আব্দুর রহমান। এই মার্কেট থেকেই তার মাসে অন্তত ৭০ লাখ টাকা চাঁদা আসে।

জানতে চাইলে মহানগর মার্কেটের দোকানদার কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন মুন্সী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার মার্কেট আব্দুর রহমান দখল করে খাচ্ছে। মাসে ৭০ লাখ টাকা ভাড়া তোলে। এই টাকার একাংশ খরচ করে সবার মুখ বন্ধ করে রাখেন। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনারসহ অনেকের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও আমি সফল হইনি। উলটো মিথ্যা অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে চার বছর আমাকে জেল খাটিয়েছে। রাস্তার টোকাই থেকে আব্দুর রহমান এখন শতকোটি টাকার মালিক। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) খোঁজ নিলে আব্দুর রহমানের অবৈধ সম্পদের পাহাড় বেরিয়ে আসবে।’

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More