ভেনিসে বাংলাদেশির বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব, দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

0

ইতালির ভেনিসে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন এক বাংলাদেশি। ইতালির মিলানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে ভেনিসের মেয়র অফিসে অনুমতি চেয়েছেন তিনি। তার পরিকল্পিত বিনিয়োগের অংকটি বড় হওয়ায় ইতোমধ্যে তাকে নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও, কারণ দেশে যখন ডলার সংকট প্রকট তখন কোনও বাংলাদেশি বিদেশে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ভেনিসে যিনি বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন, তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক হলে ইতালিতে বিনিয়োগ না করে দেশে বিনিয়োগ করতেন। কারণ, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের উত্তম স্থান। সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারাও দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’ অবশ্য অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, এই বিনিয়োগকারীর নাম মো. ডাবলু চৌধুরী। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তবে ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন। পড়াশোনা করেছেন সুইজারল্যান্ডে। বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেরও নাগরিকত্ব রয়েছে তার। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। কয়েকজন ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে মিলে এ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে এপসিলন মোটরস ইনকরপোরেশন নামে একটি বিদ্যুৎচালিত গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এখন এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ইলেকট্রিক বা বিদ্যুৎচালিত গাড়ি নির্মাণের কারখানা তৈরির জন্য তারা ভেনিসে বিনিয়োগ করার আবেদন করেছেন।

ভেনিসে বাংলাদেশির বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব, দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ভেনিসের পোর্তো মারঘেরা নামক বন্দর নগরী, যেটি মূলত একটি শিল্পাঞ্চল, সেখানে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে এতে প্রায় ১ হাজার কর্মীর চাকরির ব্যবস্থা হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিনি যদি বাংলাদেশ থেকে টাকা না নিয়ে থাকেন, তাহলে পৃথিবীর যেকোনও দেশে উৎপাদন হলেই মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনে। তবে এই বিনিয়োগ ইতালিতে না হয়ে যদি বাংলাদেশে হতো তাহলে আরও বেশি ভালো হতো। অবশ্য বিনিয়োগকারী যেখানে সুবিধা পাবেন সেখানেই বিনিয়োগ করবেন এটাই স্বাভাবিক।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনে করেন, এই বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশের অনেকের সেখানে কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম মাহফুজুর রহমান বলেন, ইতালিতে বিনিয়োগ করতে চাওয়া বাংলাদেশি এক্ষেত্রে সাধুবাদ পেতে পারেন। আমরা যেটুকু বুঝতে পারছি, এমনিতেই তার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে দেশের বাইরে। ফলে তার পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে এটি একটি খুশির খবর হলো- ইতালিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেকেই উপকৃত হতে পারবেন।

ভেনিসে বাংলাদেশির বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব, দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা (ডেপুটি গভর্নর) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বৈশ্বিক এই সংকটকালে বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারে। বিশেষ করে ইতালির ভেনিসে যিনি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক হলে এই সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতেন। কারণ, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের উত্তম স্থান। বিশেষ করে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি নির্মাণের কারখানা তৈরির উপযুক্ত স্থান বাংলাদেশ।’

তিনি উল্লেখ করেন, ইতালির এই বিনিয়োগ দেখাদেখি অন্যরা উৎসাহিত হয়ে ভিন্ন দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। যেটা মোটেও কাম্য নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা মনে করেন, ইতালিতে বিনিয়োগ না করে তিনি যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতেন তাহলে আরও ভালো হতো। কারণ বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের এই দেশে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। এই বৈশ্বিক সংকটকালে বাংলাদেশে তিনি বিনিয়োগ করলে তাকে সাধুবাদ দেওয়া যেতো।

যদিও সাতটি শর্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে বিনিয়োগ করার অনুমতি পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে প্রথম একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় সরকার। এরপর বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে।

বিধিমালা অনুসারে, বিনিয়োগে আগ্রহী যেকোনও প্রতিষ্ঠান তাদের আগের পাঁচ বছরের গড় রফতানি আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অথবা তার সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে প্রদদর্শিত নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সভাপতি করে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ওই কমিটি সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের অনুমতি দেবে।

ভেনিসের পোর্তো মারঘেরায় কর্তৃপক্ষ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই শিল্পকারখানাকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। এই কারণে আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনও দেশের বদলে ইতালিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা চিঠিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৯২০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ইতালিতে অনুমতি পেলে তারা ২০২৩ ভেনিসে এ কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করবেন। তবে এই বিদ্যুৎচালিত গাড়ির কারখানার পাশাপাশি লিথিনিয়াম ব্যাটারি তৈরির কারখানা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের মূল পরিকল্পনায়।

জানা গেছে, ইতালির ভেনিসের পোর্তো মারঘেরায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তা মো. ডাবলু চৌধুরী বিনিয়োগের জন্য এখন প্রস্তুত রয়েছেন। ইতিমধ্যেই তিনি নিজের ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল, এম এইচ জে জাবেদসহ শহরে ব্রুগনারো জান্তার কাউন্সিলর ফর কমার্সের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং বিনিয়োগের বিষয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করেছেন।

ইতালির সরকার ইতিমধ্যে ওই ব্যবসায়ীর জন্য ২৫০ হেক্টর জায়গা নির্ধারণ করেছে। ইতালির সরকার মনে করেন এই বিনিয়োগে কমপক্ষে ১০০০ ইতালীয় মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

প্রসঙ্গত, ইতালিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই দেশটিতে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু সেসব বিনিয়োগের আকার বেশি বড় নয়। মূলত দেশটির কৃষি ও সেবা খাতে সেসব বিনিয়োগ করা হয়েছে।

ডাবলু চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, ইতালিতে বিনিয়োগের প্রস্তাবটি মার্কিন কোম্পানি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এপসিলন মোটরসের প্রধান এবং একজন বাংলাদেশি হিসেবে তিনি দূতাবাসের সাহায্য চেয়েছেন।

তিনি আরও জানিয়েছেন, পরিকল্পিত কারখানার জন্য তার বিনিয়োগ আসবে যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের একদল ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টের কাছ থেকে। এই উদ্যোক্তা মনে করেন, উৎপাদন শুরু হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো রাজ্যে, ইংল্যান্ডে এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির প্রাধান্য থাকবে।

উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More