রাসূল সা:-এর অর্থনৈতিক সংস্কার বনাম বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট

0

রাসূল সা: ছিলেন বিশ্বনবী যদিও তাঁর আগমন হয়েছিল মক্কায়। সে সময় আরবে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’, অর্থাৎ অজ্ঞানতা বিরাজ করছিল। এই অজ্ঞানতা অর্থ লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিল তা নয়; বরং এই অজ্ঞানতা হলো ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে অজ্ঞানতা। ওই সময় শক্তিমানের মুখের কথাই ছিল আইন। অবাধে চলত অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, হত্যা ও রক্তপাত। ছিল না সুবিন্যস্ত কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা, অবিসংবাদিত কোনো নেতৃত্ব। জৈবিক চাহিদা পূরণ বা বৈষয়িক ভোগ-বিলাস ছাড়াও মানবজীবনের যে, মহিমান্বিত কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকতে পারে সে কথা যেন তারা কল্পনাও করত না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত ছিল সমাজ। গোত্রগুলোর মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয় চেতনা ছিল না। মারামারি ও যুদ্ধবিগ্রহ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কোনো কোনো যুদ্ধ চলত শতাব্দীকাল অবধি।

রাসূল সা:-এর আগমনের আগে আরবের অবস্থা
তাঁর আগমনের আগে আরবের অধিবাসীদের ধর্ম বলতে কিছুই ছিল না। তারা ছিল স্বাধীন। তাদের আমানতদারী, সাহস, অতিথিপরায়ণতা, সত্যবাদিতা, স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। বছরে চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তারা ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছিল না; ছিল ইবরাহিম আ:-এর একান্ত অনুসারী, একনিষ্ঠ একত্ববাদী। মক্কা ছিল পুরো আরবের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সে কারণে খ্রিষ্টান রাজারা মক্কায় দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। তখন সেখানকার অবস্থা ছিল নিম্নরূপ-

শিরক ও বিদয়াতের প্রচলন : মক্কার লোকেরা ছিল ইসমাইল আ:-এর বংশধর এবং জন্মগতভাবেই তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী। তারা কাবাগৃহকে আল্লাহর গৃহ বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো নবী না আসায় শয়তানের প্ররোচনায় তাদের অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং মূর্তিপূজার শিরকের সূচনা হয়। তবে মূর্তিপূজাকে তারা শিরক নয়; বরং বিদয়াতে হাসানাহ; অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মনে করতেন। শিরক ও বিদয়াতসমূহ চালুর পরও তাদের অহঙ্কার ছিল, তারা ইবরাহিম আ:-এর দ্বীনে হানিফার খাঁটি অনুসারী। তারা কাবাগৃহের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক।

আরবের সামাজিক অবস্থা : তৎকালীন আরবের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা খুবই উন্নত ছিল। পুরুষপ্রধান সমাজব্যবস্থা থাকলেও নারীদের মর্যাদা ছিল। অপরপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের সামাজিক ব্যবস্থা গোত্রভিত্তিক হওয়ার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক অবস্থা পরিচালিত হতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে।

অর্থনৈতিক অবস্থা : ব্যবসায় ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও বেশির ভাগ লোক মানবেতর জীবন যাপন করত। উচ্চবিত্তদের মধ্যে মদ-জুয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিত্তহীনরা দাস-দাসীরূপে বিক্রি হতো। উদার মরুচারী আরবদের নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হতো। একদিকে তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, হানাহানি লেগে থাকত- অন্যদিকে, সাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা, দানশীলতা, আমানতদারি, মেহমানদারির সমাবেশ দেখা যেত।

রাসূল সা:-এর আগমনের পরে মক্কায় কার্যক্রম : রাসূল সা: ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মলাভ করেন এবং মাত্র ৪০ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। প্রথমেই মাতৃভূমি মক্কার মানুষকে এক আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। মক্কাবাসী তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তাঁর ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। পরে আল্লাহর আদেশে মদিনায় হিজরত করেন। মাত্র ২০ বছরে তার দূরদর্শিতা দিয়ে তিনি সভ্যতা-বিবর্জিত পৌত্তলিক আরব জাতিকে এক সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছেন। অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী নতুন কর্মসূচির সূচনা করেন। তার কর্মনীতি অনুসরণ করে স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বে শোষণমুক্ত ও কল্যাণধর্মী নতুন এক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল।

রাসূল সা:-এর মক্কায় অর্থনৈতিক কাজের অভিজ্ঞতা : তখন আরব দেশে পোশাক শিল্প, চর্মকার ও রাখালের পেশা ইত্যাদি যৎসামান্য কিছু কর্ম ছাড়া তেমন কোনো শিল্পের প্রসার ছিল না। ব্যবসায়ই ছিল তাদের আয়-উপার্জনের প্রধান অবলম্বন। তিনি শিশুকাল কাটিয়েছিলেন পবিত্র নগরী মক্কায়। কোরাইশরা তখন ধনাঢ্যতা ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক ছিল। খাঁটি বাণিজ্যিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেন মহানবী সা:। ১২ বছর বয়সে রাসূল সা:-তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যিক কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন। যৌবনে উপনীত হওয়ার পর মেষ চরানো ও পরে ব্যবসায়ের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর অর্থনৈতিক জীবন।

লাভ-লোকসানের ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা : খাদিজা রা: ছিলেন একজন ধনবতী ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। তিনি মহানবী সা:-এর সততা ও উত্তম চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, দৈহিক শক্তি এবং বিচক্ষণতার কথা জানতে পেরে তাঁকে পুঁজি দিয়ে মুদারাবার (অংশীদারিত্বের) ভিত্তিতে ব্যবসায় শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার ব্যবসায়িক সফলতা দেখে বিস্মিত হন খাদিজা রা:। ফলে তিনি রাসূল সা:-এর সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী হিসেবে তিনি খাদিজার ব্যবসায় তত্ত্বাবধান করতেন এবং নিজেও সেই পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় করছিলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি চাচা জুবায়ের রা:-সহ কয়েকজন যুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুজল’ নামে একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজস্ব ও খাদিজা রা: থেকে প্রাপ্ত পুঁজি দিয়ে নতুন ধর্মের প্রচার করতে লাগলেন। নওমুসলিম সাহাবিদের মধ্যে যারা সামর্থ্যহীন তাদের খরচাদি রাসূল সা: নিজেই বহন করেছিলেন।

মদিনায় অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম
ইহুদি-নাছারারা কেনআন (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে মদিনায় এসে বসবাস শুরু করেছিল। কারণ তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস হারিয়েছিল, অতএব বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকলে নিয়মিত হজ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাসিল করবে। কিন্তু, মদিনার মানুষ তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও শ্রেণিবৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। সুদের কবলে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছিল। নারীরা সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতো। এতিমরা অধিকার থেকে বিতাড়িত। সর্বনাশা জুয়ার খপ্পরে পড়ে মানুষ হয় সহায় সম্বলহীন। ব্যবসায়িক অসাধুতার কারণে জনসাধারণ জিম্মি। হারাম উপার্জনের তোড়জোড়ের কাছে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ হচ্ছে অবহেলিত। রাসূল সা: তাদের মুক্তির দিশা দেন। অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করার কাজে হাত দেন। কারণ, একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব-সমৃদ্ধি নির্ভর করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার ওপর।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : হিজরত ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করা ও সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক কাঠামো রচনা করা। অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত মুহাজিররা নিজেদের ধন-সম্পদ মাতৃভূমি মক্কায় রেখে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় প্রবেশের পর আনসাররা তাদের জমিজমা ও ধনসম্পদ থেকে উদ্বৃত্ত সব কিছু তাঁর কাছে সমর্পণ করতে শুরু করলেন। রাসূল সা:কেও মুহাজিরদের ব্যয়ভার নির্বাহে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি কার্যত শ্রমের যে আদর্শ পেশ করেছিলেন তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুহাজিররাও আনসারদের ওপর বোঝা সৃষ্টি না করে কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এভাবেই গড়ে উঠছিল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক বন্ধন।

বাজার প্রতিষ্ঠা : রাসূল সা: মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে তাঁর অসীম প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, মুহাজিররা কৃষিকাজ জানতেন না। ব্যবসায়ই ছিল তাদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন। তাই রাসূল সা: মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই বাজার প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেছিলেন। ভ্রাতৃত্ববন্ধন ছিল নতুন ইসলামী অর্থনৈতিক বিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ।

রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পদের উৎস
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। অর্থনীতি তারই একটি অংশ। মানুষ কীভাবে অর্থ উপার্জন, ব্যয় ও ভোগ করবে সে সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হিসাবে রাসূল সা: কুরআনের আলোকে অর্থনীতি সংস্কার করেন। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদে যাতে জনসাধারণের অধিকার ও ভোগ করার সুযোগ থাকে তার জন্য ছয় প্রকারের রাজস্বের প্রবর্তন করেন। এখানে তার বর্ণনা দেয়া হলো-

জাকাত : জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। জাকাত দানের মুখ্য উদ্দেশ্য গরিবদের অবস্থার পরিবর্তন করা, আর্থিকভাবে সচ্ছলতা লাভ করার ব্যবস্থা করা, অভাব থেকে মুক্তি দেয়া। জাকাত আদায়ে সমাজের কাঠামো তৈরি হয় এবং অর্থনীতিতে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়।

উশর : উশর কৃষিজাত পণ্য ফল ও ফসলের জাকাত। এটি আদায় করা ফরজ। এর ব্যয়ের খাত জাকাতের মতোই।
nayadiganta

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More