ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অধিকাংশ ধারাই সাইবার নিরাপত্তা আইনে হুবহু প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তবে কয়েকটি ধারায় অপরাধের সংজ্ঞায় নতুন কিছু শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। অজামিনযোগ্য ৮টি ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ছয়টি ধারা অজামিনযোগ্যই রয়ে গেছে। তবে কয়েকটি অপরাধের ক্ষেত্রে একই কাজের পুনরাবৃত্তির জন্য সাজার বিধান বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির অধীনে সার্বক্ষণিক ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের বিধানও রয়েছে এই আইনের খসড়ায়। সাংবাদিকদের জোর আপত্তি সত্ত্বেও ডিএসএ-এর নয়টি ধারা এবং এর সব উপধারা প্রায় অপরিবর্তিত রেখে নতুন আইনের খসড়ায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশিষ্টজনদের আশঙ্কা, আইনে আমূল পরিবর্তন না এনে সাজা কমালে অপব্যবহারের আশঙ্কা কোনোভাবেই কমবে না।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন আইনের খসড়ার মাধ্যমে আমাদের যা শঙ্কা ছিল তাই প্রতীয়মান হলো। এটি নতুন মোড়কে পুরোনো আইন। এর পুরোটাই লোক দেখানো। ভয়ের সংস্কৃতি ও নজরদারিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেই আইনটি করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তার কথা বলে অযাচিতভাবে সেখানে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। তারা কিছু একটা করেছে, এটা বোঝাতেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নামে আইনের খসড়াটি প্রণয়ন করেছে। সাজা কমানোর বিষয়টিও এরই অংশ। এর মাধ্যমে এ আইনে হয়রানি কোনোভাবেই কমবে না।
২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ৯টি ধারা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়। এগুলো হলো-৮, ২১, ২৫, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল সাংবাদিকদের মধ্যে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ২৯ ধারার সংজ্ঞায়ও মানহানিসংক্রান্ত বিষয়টি রাখা হয়েছে। তবে এ ধারায় গ্রেফতারের বিষয়টি রোহিত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ ধারার শাস্তি ছিল তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা। একই অপরাধ বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। বিপরীতে পরিবর্তিত আইনে এ ধারায় কারদাণ্ড বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়।
অপরদিকে ডিএসএ-এর ২৮ ধারায় ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উসকানি দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ করলে শাস্তি ছিল পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ বারবার করলে সাজা ও জরিমানার মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল। এই ধারায় সাজা কমিয়ে ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়।
ডিএসএ-এর ৩১ ধারায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর ধারাটি হুবহু নতুন আইনের খসড়ায় সংযোজন করা হয়। তবে সাজার মেয়াদ কমানো হয়েছে। আগের আইনে এর সাজা ছিল ৭ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জারিমানা অথবা উভয় দণ্ড। নতুন আইনে সাজা সাত থেকে দুই বছর কমিয়ে ৫ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়। অর্থাৎ এখানে জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছে।
ডিএসএ-এর ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের দণ্ডের বিষয়টি নতুন খসড়া আইনে ৩২ ধারাতেই রাখা হয়েছে। ডিএসএতে এ আইনে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। নতুন আইনে এ ধারায় সাজা কমিয়ে ৭ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়। ডিএসএতে এই ধারার অপরাধ দ্বিতীয়বার সংঘটনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিদান ছিল। পরিবর্তিত খসড়া আইনে সেই বিধানটি রহিত করা হয়।
ডিএসএ-এর ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারসংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে। এই ধারাটি বাতিলে বা সংশোধনে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মীসহ সব মহল থেকে জোর দাবি ওঠে। তবে খসড়া আইনে এ ধারাটিকে ৪২ ধরায় হুবহু রাখা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়নি এর উপধারাগুলোও।
এছাড়া ডিএসএ-এর বিতর্কিত ৮ ধারা হুবহু রাখা হয়েছে। সেখানে কেবল ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে ইলেকট্রনিক মাধ্যম যুক্ত হয়েছে। খসড়ায় ২৫ ধারা হুবহু রয়েছে। কেবল পুনরায় একই অপরাধে ৫ বছর দণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল, সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ২১ ধারায় ফের অপরাধের দণ্ডের উপধারা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া সাজার পরিমাণ ১০ বছর থেকে ৩ বছর কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। ডিএসএ-এর অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতার ৫৩ ধারটি নতুন আইনের খসড়ায় সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে ৫২ ধারায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
আইনের প্রয়োগ : এর প্রয়োগের বিষয়ে বলা হয়, এই আইনের কোনো বিধানের সঙ্গে যদি অন্য কোনো আইনের কোনো বিধান অসামঞ্জস্য হয়, তবে অন্য কোনো আইনের বিধানের সঙ্গে এই আইনের বিধান যতখানি অসামঞ্জস্য হয় ততখানির ক্ষেত্রে এই আইনের বিধান কার্যকর থাকবে। তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর বিধানাবলি কার্যকর থাকবে।
আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগের বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে যা বাংলাদেশে করলে এই আইনের অধীনে দণ্ডযোগ্য হতো, তাহলে এই আইনের প্রযোজ্যের বিধান এমন হবে যে, তিনি অপরাধটি বাংলাদেশেই করেছেন।
যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে থেকে দেশে অবস্থিত কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে দেশের অভ্যন্তরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে আইন এভাবে প্রযোজ্য হবে যে, দেশের ভেতরেই অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে। দেশে থেকে দেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করলে দেশেই অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে একজন মহাপরিচালক, দুজন পরিচালকের সমন্বয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি নামে একটি এজেন্সি গঠন হবে। এর বাইরে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী এজেন্সির প্রয়োজনীয় জনবল থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল নামের পরিবর্তন ও কিছু ধারায় সাজা কমিয়ে সাইবার সিকিউরিটি আইন হলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) মূলত বিতর্কিত হয় এর নিবর্তনমূলক বেশকিছু ধারার কারণে। এই বিতর্ক কেবল সাজার বিধান নিয়ে ছিল তা নয়। বরং যেসব অভিযোগে কাউকে এই আইনে বিচারের আওতায় আনা যাবে তার অস্পষ্টতা এবং অপব্যবহার ছিল বিতর্কের কেন্দ্রে। কারণ সাজা হলো বিচারের সর্বশেষ ধাপ। সেখানে কেউ নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে খালাসও পেতে পারেন। কিন্তু এই সাজার আগেই নিজেদেরকে নিরপরাধ প্রমাণে বছরের পর বছর ভুক্তভোগীদের গ্রেফতারসহ নানা হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। এজন্যই আইনটি বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ফলে নিবর্তনমূলক ধারাগুলোর সাজা কমানো সামগ্রিক অর্থে ভোগান্তি থেকে জনগণকে রেহাই দেবে না। ডিএসএ-তে চলমান সাড়ে পাঁচ হাজার মামলাসহ ভবিষ্যতে যারা পরিবর্তিত আইনে বিচারের আওতায় আসবে তারা একই ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হবে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হয়। ওই বছর ৮ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এরপর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়। সুপ্রিমকোর্টের গোপনীয় শাখার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৫ হাজার ৫১২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বড় একটি অংশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের দায়ে অনেক গণমাধ্যমকর্মীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৭ শতাংশ মামলাই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি হয়েছেন ৩৫৫ সাংবাদিক। আইন প্রণয়নের পর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ১২৯৫টি মামলা বিশ্লেষণ করে তারা এ তথ্য দিয়েছে। তবে এই আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমরা যেসব কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের কথা বলছিলাম, সেই অর্থে যদি কোনো গুণগত পরিবর্তন না হয় তাহলে এই ধরনের আলংকারিক পরিবর্তন লোকদেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাগরিকদের নানাভাবে হয়রনি ও নিপীড়নের সুযোগ-সম্ভাবনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে আইন নিজেই সবার জন্য অনিরাপত্তা তৈরি করছে, তা কখনোই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হতে পারে না। সেই দিক থেকে মৌলিক কোনো পরিবর্তন না আসলে পরিবর্তনের যৌক্তিকতা নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আইনমন্ত্রী বললেন, ‘নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হয়েছে, নাম পরিবর্তনে সেটা অন্তত কাটবে।’ এর থেকেই তো তারা এক ধরনের স্বীকারোক্তি দিলেন যে এই আইন মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করেছে। আইন তো সরকারের জন্য না। জনগণের প্রয়োজনে আইন। দণ্ড বাতিল করে জরিমানার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা দিতে না পারলে তাকে জেল খাটতেই হচ্ছে।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে ভিন্নমত দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পিপি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্বারা নিপীড়নের বিষয়টি যেভাবে সামনে আনা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। এটি মূলত সব ধরনের মানুষের সুরক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কেউ এর দ্বারা হয়রানির শিকার হলে প্রচলিত আইনে প্রতিকার চাইতেই পারে। সাইবার সিকিউরিটি আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি বলেন, সব যে হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে তা নয়। গত ছয় মাসে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে প্রায় ৫০ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলেই সাজা হয়েছে।
jugantor