২৪ লাখ টাকা দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার পর লাশ হলেন রফিকুল

0

‘বাবা, আমার অবস্থা ভালো না। আমি মনে হয় বাঁচব না। তোমাদের স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারলাম না। বাবা তোমরা ভালো থেকো। সবাইকে দেখে রাইখো।’ তিন দিন আগে ইতালির একটি হাসপাতালের শয্যা থেকে এটাই ছিল বাবার সঙ্গে রফিকুল ব্যাপারীর (২২) শেষ কথা। এরপর রফিকুলের সঙ্গে তাঁর পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

বাংলাদেশ সময় আজ বুধবার বেলা ১১টায় ইতালির একটি হাসপাতাল থেকে মুঠোফোনে খবর আসে রফিকুল আর বেঁচে নেই। অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে রফিকুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতালিতে পৌঁছানোর পর রফিকুলকে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেছেন রফিকুলের বাবা হাবিব ব্যাপারী।

রফিকুলের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের শ্রীনদী এলাকায়। চার ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ভাই রফিকুল। বাবা হাবিব ব্যাপারী স্থানীয় বাজারের চায়ের দোকানদার।

বিকেলে রফিকুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির চারপাশে মানুষের ভিড়। রফিকুলের বড় বোন একটু পরপর নিজের মুঠোফোনে ভাইয়ের ছবি বের করে কাঁদছেন। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে মা-বাবাসহ বাড়ির সবাই বাকরুদ্ধ। স্বজনদের আহাজারির মধ্যে প্রতিবেশী অনেকেই তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ভাইকে খুব নির্যাতন সইতে হইছে। লিবিয়া থিকাই ভাইডা অসুস্থ ছিল। সারা দিন রোদের মধ্যে সাগরে থাকায় ভাইডা আরও অসুস্থ হইয়া পড়ে। ভাইর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবে। ওখানে গিয়া সংসারের হাল ধরবে। ভাইডা আমার ইতালি ঠিকই পৌঁছাল, কিন্তু বাঁচল না।

রফিকুলের বড় বোন রাবিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ভাইকে খুব নির্যাতন সইতে হইছে। ঠিকমতো খাইতে দিত না। লিবিয়া থিকাই ভাইডা আমার অসুস্থ ছিল। সারা দিন রোদের মধ্যে সাগরে থাকায় ভাইডা আরও অসুস্থ হইয়া পড়ে। ভাইর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবে। ওখানে গিয়া আয় কইরা আমাগো সংসারের হাল ধরবে। ভাইডা আমার ইতালি ঠিকই পৌঁছাল, কিন্তু বাঁচল না। সরকারের কাছে দাবি, ভাইডার লাশ যেন দ্রুত দেশে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়।’

রফিকুলের স্বজনেরা জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় দালাল আলমগীর খাঁর মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান রফিকুল। এরপর লিবিয়ার মাফিয়াদের বন্দিশালায় রফিকুলের কষ্টের জীবন শুরু হয়। টাকার জন্য দালালদের নির্যাতন সইতে হয় তাঁকে। মুক্তিপণের জন্য দালালের মাধ্যমে কয়েক দফায় প্রায় ১৯ লাখ টাকা লিবিয়া পাঠান রফিকুলের বাবা হাবিব ব্যাপারী। চলতি মাসের শুরুতে রফিকুলসহ শতাধিক তরুণকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি উপকূলে পাঠায় দালাল চক্র। কিন্তু সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় রফিকুলসহ অন্তত ১৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতালির পুলিশ তাঁদের জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। এর মধ্যে রফিকুল আজ মারা যান।

রফিকুলের বাবা হাবিব ব্যাপারী বলেন, ‘একমাত্র পোলাডারে ইতালি পাঠাইতে কয়েক ধাপে ধারদেনা ও জমি বেইচা ২৪ লাখ টাকা দালালের কাছে দিই। দালালরে হাতজোড় কইরা অনুরোধ কইরা কইছিলাম, পোলাডারে যেন ভালোমতো ইতালি পৌঁছাইয়া দেয়। পোলা ইতালিতে পৌঁছাল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া গেল। দালাল আমাগো কথা শোনে নাই। লিবিয়ায় ওর লোকজনের কারণে আমার পোলাডারে নির্যাতন সইতে হয়। দালালের নির্যাতনের কারণেই আমার পোলাডা মইরা গেল।’

অভিযুক্ত দালাল আলমগীর খাঁর বাড়ি পাশের ধুরাইল ইউনিয়নের হোসেনের হাট এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলমগীর এলাকায় থাকেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও বাড়িতে নেই। ফাঁকা বাড়ি পড়ে আছে। তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

লিবিয়া থেকে কাঠের নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ঠান্ডায় মারা যাওয়া রাশেদুল ইসলাম

মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ইতালিতে চিকিৎসাধীন তরুণ মারা যাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে কোনো পরিবার যদি পুলিশের কাছে আইনি সহযোগিতা চায়, তাহলে তাঁরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।

উৎসঃ   প্রথমআলো
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More