নগ্নতা! আমাদের দেশের মানুষের কাছে এখনও প্রকাশ্যে গা সওয়া হয়নি বিষয়টি। কিন্তু, তাই বলে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড! প্রতিটি যুবক তার যৌবনের অধিকাংশ সময় নগ্ন নারীর ছবি এবং কথা ভেবে কাটিয়ে দিলেও রাস্তা-ঘাটে কোনও নারীর ‘অশালীনতা’ মেনে নিতে পারবে না। কেউ-কেউ তো পারলে অশালীনতার প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নারীকে ধর্ষণ করেই ফেলে!
ইন্টারনেট ও কেবল নেটওয়ার্কের কল্যাণে সারাদিন আইটেম কন্যার নগ্ন উরুর মাঝে ডুবে থাকলেও দেশি মেয়ের খোলা পিঠ দেখলেই জাত গেল, ধর্ম গেলো কত শত শাপ-শাপান্ত। পুঁজিবাদী বিশ্বে নারীর নগ্নতা মুনাফার ট্রামকার্ড হয়েছে। কিন্তু তাই বলে পুঁজির বাইরে গিয়ে মেয়েরা নিজেদের শরীরের অধিকারই বা কতটুকু পেয়েছে?
সম্প্রতি ‘ধর্ষণ কি পোশাকে না মানসিকতায়’ শিরোনামের একটি লেখাতে ১২শ মন্তব্য এসেছে। এসব মন্তব্যের অধিকাংশই পোশাককে দায়ী করে এবং মন্তব্যকারীদের সবাই পুরুষ। যারা ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মতো ভয়াবহ অপরাধকে পোশাকের দোহাই দিয়ে জায়েজ করতে চায় তাদেরকে ‘নোংরা মানসিকতার’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি কিন্তু আমাদের চারপাশেই এদের বসবাস। আমাদের পাড়া মহল্লা, কর্মক্ষেত্রে এদের বসবাস।
রাস্তাঘাটে হাঁটার সময় আমি মেয়েদের দেখি– মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ, মতিঝিল এলাকায় মেয়েরা কী পোশাক পরে যা ‘শালীনতায়’ আঘাত করে। পুরুষরা তো রাস্তা-ঘাটে অর্ধনগ্ন হয়ে এমনিতেই ঘুরে বেড়ায়, লুঙ্গি পড়া, গামছা পড়া, খালি গা পুরুষদের আমরা অহরহ দেখি- শালীনতার কোনও দায় নেই তাদের। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই শালীনতা কথায়-কথায় বিপন্ন হয়!
মানুষ কী পোশাক পরবে, কোথায় কার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রতিটি ব্যক্তিরই থাকা উচিত। যৌন নিগ্রহ এবং ধর্ষণ এই স্বাধীনতাকে তছনছ করে। মনের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়ার যে অভ্যাস মানবসভ্যতা গড়ে তুলেছে, তা কি শুধু কয়েকজন হিংস্র ও লম্পট পুরুষের একচেটিয়া অধিকার হয়ে থাকবে? ওই লম্পটরা অপরাধী গোত্রের। কিন্তু বাদবাকি সমাজের এ বিষয়ে চরম উদাসীনতা দেখানো এবং যৌন দুষ্কর্মের বলি মেয়েদের প্রতি সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ আরও বড় অভিশাপ। আর পুলিশ ও প্রশাসনে আসীন বিবেকহীন বাস্তুঘুঘুরা আশ্চর্যভাবে যৌন অপরাধীকে আড়াল করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে।
কথা হলো, রাবণ যদি সীতার শ্লীলতাহানি করেও থাকে, এমন কী ধর্ষণও তাতে সীতা কেন ভিকটিমাইজ হবে? অথচ সীতা অপহরণের শিকার হয়েও তার প্রতি রামের সন্দেহ যত দ্রুতগামী ছিল, রাবণের লালসা ততোটা না! ধর্ষিত হলে মেয়েদের উল্টো সমাজ থেকে, পরিবার থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়! আর ধর্ষণের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করলে পুলিশ, প্রশাসন, সমাজ, রাজনৈতিক দল-সবাই ধর্ষণকারীকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ও প্রোটেকশন দেবে। এ কোন সমাজে বসবাস করছি আমরা?
সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় ক্ষমতাবান অর্থবান পুরুষরা পেটে দু এক পেগ পড়লে একটু-আধটু ফষ্টি-নষ্টি করবেই। তাদের এই ফষ্টি-নষ্টির মধ্যেও আছে সমাজের প্রশ্রয়। কিন্তু যেসব মেয়েরাও এসব নোংরামির শিকার তাদের কিন্তু প্রশ্রয় দেয় না সমাজ। তাদের একঘরে করে। আবার ধর্ষণ করে। শেষে পাথর ছুড়ে মারে। আর যেসব মেয়ে প্রতিবাদ করে তাদের অবস্থাও সঙ্গীন হয়।
বাসে ভিড় হলে কতগুলো লোক এসে মেয়েদের গায়ে গা ঘষবে। হাত চালাবে। প্রতিবাদ রোজই কোনও না কোনও মেয়ে করে। তখন অন্য পুরুষরা ওই গা ঘষা লোকগুলোর সমর্থনে গলা চড়াবে,’আপা সিএনজি বা ট্যাক্সিতে করে যান না’। যেন মেয়েরা শখ করে বাসে চড়েছে। কিছু লোক ভাবে এসব মেয়েরা বানিয়ে বলছে। কোনও ছেলে কী এতো খারাপ হতে পারে! অথচ ভাবনার চেয়েও খারাপ হয়ে ওঠে যখন আদিবাসী তরুণী মাইক্রোবাসে গণধর্ষণের শিকার হয়।
মেয়েরা একটু আধটু ফষ্টি-নষ্টি মেনে নেবে নীরবে, প্রয়োজনে সহযোগিতা করবে। এটাই কর্মসূত্রে বাইরের পৃথিবীতে আসা মেয়েদের সম্বন্ধে দেহবাদী পুরুষদের ভাবনা। প্রতিবাদ করলেই বলে, আরে কতো সতী জানা আছে। কিন্তু বাস্তবে ‘সতীপনার’ সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। সতীত্ব একটা চাপিয়ে দেওয়া ভুয়ো ধারণা।
একজন মানুষ কার সঙ্গে বা কতোজনের সঙ্গে কী সম্পর্ক গড়ে তুলবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক থাকতেই পারে কোনও মেয়ের, তার মানে এই নয় যে অফিসের বসের যৌন হয়রানি সে উপভোগ করবে। এটা পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার, ব্যক্তির সঙ্গে মানসিক সম্পর্কের ব্যাপার। সব স্বাভাবিক মেয়েই অপছন্দের পুরুষের যৌন অত্যাচারে অপমানিত বোধ করে। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্তবোধ করে। তা সে একপুরুষে নিষ্ঠাই হোক আর একাধিক পুরুষে।
বিনা মজুরির শ্রম ও প্রজননের জন্য এই সমাজের মেয়ে দরকার, দরকার ধর্ষণের জন্য কিন্তু তাদের স্বার্থ রক্ষার দায় এ সমাজ তো নেয়ই না উপরন্তু নারীর অস্তিত্বই বিপন্ন করে তোলে। একুশ শতকে পা রেখেও নারীর ব্যক্তিসত্ত্বা ও সামাজিক অস্তিত্বের ওপর চলতে থাকা এই আঘাতকে যে সমাজ যথেষ্ট সিরিয়াসলি নিতে ব্যর্থ হয় সে সমাজকে ধিক্কার জানাই।
মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কোনও দিনই লৈঙ্গিক সাম্য আসবে না। পাঠ্যসূচির মধ্য দিয়ে ছোট থেকেই তৈরি করা দরকার লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজের উপযুক্ত নতুন প্রজন্ম। আর দরকার সরকার পুলিশ ও প্রশাসনে বসে থাকা বাস্তুঘুঘুদের মগজ ধোলাই ও সংশোধন। তথ্য সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার