১৬ টাকা থেকে হাজার কোটি টাকা আর কমলা লেবুর ফেরিওয়ালা থেকে ২৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের এমডি হয়েছেন শেখ আকিজ উদ্দিন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পৃথিবীর পাঠশালা থেকে জ্ঞান অর্জন করে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ মানুষের ত্রানকর্তা হয়েছেন। আমাদের আজকের আইকন শেখ আকিজ উদ্দিন। তাঁর শূন্য থেকে শীর্ষে পৌঁছার গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
মা-বাবার একমাত্র ছেলে, তবু পড়ালেখা হলো না শেখ আকিজ উদ্দীনের। পেটে যদি ভাত না জোটে মাথায় বিদ্যা ঢুকবে কী করে? তাই পেট বাঁচাতে পথে নেমে পড়লেন আকিজ উদ্দীন। বয়স তখন মাত্র ১৩। পকেটে ১৬ টাকা নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়।
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। চারিদিকে অভাব আর দুর্ভিক্ষ। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ১৬ টাকা ধরে রেখে হাঁটা দেন কিশোর আকিজ। খুলনার বামনডাঙা গ্রাম থেকে ফুলতলা স্টেশন-দূরত্বটা নেহাত কম নয়। ঘেমে নেয়ে একসময় স্টেশনে পৌছান। তারপর কলকাতাগামী ট্রেনে চেপে বসেন।
ট্রেন কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে থামলে তিনি নেমে পড়েন। কী করবেন ভাবতে ভাবতে রাত ঘনিয়ে আসে। তিনি প্ল্যাটফর্মেই রাতটা কাটিয়ে দেন। হাতের মুঠোয় তখনো ১৬ টাকা। সকাল হলে পাশের বাজার থেকে কিছু কমলা লেবু কিনে স্টেশনে ফেরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন।
শুরু হয় আকিজ উদ্দীনের ফেরিওলা জীবন। কিছু দিন কমলালেবুর ব্যবসা করার পর একটি ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকান দেন আকিজ। কিন্তু একদিন পুলিশ অবৈধভাবে দোকান দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন জেল খেটে মুক্ত হয়ে আকিজ উদ্দিন উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা শহর ঘুরতে শুরু করেন। এসময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পাকিস্তানের পেশোয়ারের এক ফল ব্যবসায়ীর। আকিজ ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পেশোয়ারে গিয়ে আবার ফলের ব্যবসা শুরু করেন। বছর দুয়েক ব্যবসা করার পর তাঁর পুঁজি দাঁড়ায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ তখন ভালোভাবেই লেগেছে পাকিস্তানে। ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন আকিজ উদ্দীন।
দেশে তো ফেরা হলো। এখন কী করবেন? বন্ধুর বাবা বিধু ভূষণ বিড়ির ব্যবসা করেন, তার সঙ্গে আকিজ উদ্দীন এবার বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপশি গ্রামগঞ্জ ঘুরে ধান, পাট, নারকেল ও সুপারি কিনে আড়তে আড়তে বিক্রি করতে শুরু করেন। এভাবে সামান্য কিছু টাকা জমা হলে বাড়ির পাশে বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে একটি দোকান দেন। কিন্তু দুভার্গ্য! একদিন দোকানটি আগুনে পুড়ে যায়। আকিজ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
কিন্তু আকিজ তো ফিনিক্স পাখি। ছাইভষ্ম থেকে পুনর্বার উড়তে জানেন। তিনি ঘুরে দাঁড়ানো নায়ক। তাই এলাকাবাসীর সহায়তায় আবার দোকান দেন। পাশাপাশি শুরু করেন ধান, পাট, চাল ও ডালের ব্যবসা। এরপর তিনি সুপারির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। রাত জেগে সেই সুপারি ছিলে দিতেন তাঁর সহধর্মিণী। এই সুপারি তিনি কলকাতায় পাঠাতেন। সুপারির ব্যবসায় তাঁর বেশ লাভ হয়। এরপর তিনি বিধু বিড়ির মালিক বিধু ভূষণের পরামর্শে বিড়ির ব্যবসায় পাকাপাকিভাবে যুক্ত হন। নাভারণের নামকরা ব্যবসায়ী মুজাহার বিশ্বাসের সহায়তায় তিনি ছোট্ট একটি বিড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। শুরু হয় আকিজের উত্থান পর্ব।
বিড়ি ফ্যাক্টরির পর ১৯৬০ সালে অভয়নগরে অত্যাধুনিক চামড়ার কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৬৬ সালে ঢাকা টোব্যাকো, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্ট, নাভারণ প্রিন্টিং, ১৯৮৬ সালে জেস ফার্মাসিউটিক্যাল, ১৯৯২ সালে আকিজ ম্যাচ, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুট মিল, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট, আকিজ টেক্সটাইল, ১৯৯৬ সালে আকিজ পার্টিকেল, ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং, ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০০০ সালে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, একই বছর আকিজ অনলাইন, নেবুলা ইন্ক, ২০০১ সালে আকিজ করপোরেশন, আকিজ কম্পিউটার, আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি, ২০০৪ সালে আফিল এগ্রো, ২০০৫ সালে আফিল পেপার মিলস প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২৯ সালে খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে জন্মেছিলেন শেখ আকিজ উদ্দীন। মারা যান ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর। ৭৭ বছরের দর্ঘী জীবনে ২৩টি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসার জাদুকরে পরিণত হন শেখ আকিজ উদ্দীন। এ ছাড়া তিনি আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানরা আরো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
আকিজ উদ্দিনের ১৫ সন্তান। ১০ ছেলে পাঁচ মেয়ে। বড় ছেলে ডাক্তার শেখ মহিউদ্দিন আদ্-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ও আকিজ বিড়ির চেয়ারম্যান, অন্য সন্তানদের মধ্যে শেখ মোমিন উদ্দিন এসএএফ চামড়া ফ্যাক্টরির এমডি, শেখ আফিল উদ্দিন আফিল গ্রুপের এমডি, শেখ বশির উদ্দিন আকিজ গ্রুপের এমডি। এ ছাড়া শেখ নাসির উদ্দিন, শেখ আমিন উদ্দিন, জামিন উদ্দিন, শেখ আজিজ উদ্দিন, শেখ জামিল উদ্দিন সবাই আকিজ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।