হাসিনার রাজনীতি

0

hsinaবিয়োগান্ত এক পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে এসেছিলেন তিনি। তিন যুগের রাজনীতির ক্যারিয়ারে বহু ঝড়-ঝাপটার মুখোমুখি হয়েছেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন সাফল্যের সঙ্গেই। কখনও কখনও ব্যর্থতার স্বাদও পেয়েছেন। এরশাদ পরবর্তী জমানায় প্রথম নির্বাচনে পরাজয়ের পর অভিমানে দলীয় প্রধানের পদও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হাজির হন। তারা দাবি তোলেন, পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। বুলন্দ আওয়াজ উঠলো, ‘শেখ হাসিনা যেখানে, আমরা আছি সেখানে।’ ৫ই মার্চ ১৯৯১ শেখ হাসিনা কর্মীদের চাপে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করলেন। তবে ঘটনার তখনও বাকি ছিল। ১৪ই মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ১২ পৃষ্ঠার এক চিঠিতে দলটির তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. কামাল হোসেন বলেন ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং কর্মবিমুখতা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ।’
দলের ভেতরে-বাইরে এমন অনেক চ্যালেঞ্জই এসেছিল শেখ হাসিনার জন্য। তাকে রাজনীতির ময়দানে আনার জন্য একসময় যারা সক্রিয় ছিলেন পরে তাদের কেউ কেউ আবার বিরোধিতা করেন। দীর্ঘসময় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে দলের ভেতরে একধরনের হতাশাও তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতার মসনদে বসে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সেসময়কার শাসনামলের প্রশংসা দলটির অনেক সমালোচকও করেন। ২০০১ সালে ফের বিপর্যয়। ওয়ান ইলেভেনকে শুরুতে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানালেও পরে বুঝতে পারে কুশীলবদের এজেন্ডা ভিন্ন। সমালোচনায় সরব হন শেখ হাসিনা। একসময় তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কারাগারের দিনগুলোতে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাকে। তবে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির নাটাই চলে যায় শেখ হাসিনার হাতে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই সব কর্তৃত্ব নিয়ে নেন তিনি। দলের সংস্কারপন্থিদের আমলনামাও চলে যায় তার কাছে। নির্বাচনে সংস্কারপন্থিদের কাউকে মনোনয়ন দেন, কাউকে আবার ছিটকে দেন রাজনীতি থেকে। মন্ত্রিসভা গঠনেও সংস্কারপন্থিদের বাদ দেন। পরে যদিও তাদের অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা অবশ্য ধীরে ধীরে বিরোধীদের জন্যও রাজনীতি কঠিন করে তোলেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নেন। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেন সাহসিকতার সঙ্গে। তিনি জানতেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিই ছিল তার ট্রাম্প কার্ড। খুবই দক্ষতার সঙ্গে এটি ব্যবহার করেন তিনি। ওয়ান ইলেভেনের ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিএনপিকে আর রাজপথে ফেরার সুযোগ দেননি। সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী জামায়াত-শিবির একের পর এক ধাক্কায় শক্তি হারাতে থাকে। শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর দলটির নেতাকর্মীরাও মনোবল হারিয়ে ফেলে। পিলখানায় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেয়া হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ওই হত্যাযজ্ঞের বিচারও নিশ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর হয়। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আর ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজের নেতৃত্বকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন শেখ হাসিনা। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত অভিযান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নিয়ে যায় নতুন উচ্চতায়।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ছিল শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জও তিনি উতরান অনেকটা অনায়াসেই। খালেদা জিয়াকে মন্ত্রিসভায় যোগদান ও চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। ভুলচালে সুযোগ হারান বিএনপি নেত্রী। পশ্চিমা দুনিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও অনড় থাকেন শেখ হাসিনা। নির্বাচন পেছানোর অনুরোধ উপেক্ষা করেন তিনি। নির্বাচনের পর কি হবে এ নিয়ে চারদিকে অনিশ্চয়তা ছিল। হঠাৎ করেই বিএনপি-জামায়াত রাজনীতিতে অনেকটা ওয়াকওভার দিয়ে দেয়। আর এই সুযোগে সবকিছু গুছিয়ে ওঠে সরকার। আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদের শেষদিকে উত্থান হওয়া হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে করা হয় একধরনের সমঝোতা। অন্যদিকে, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয় বহুগুণ। একাধিক মেগা প্রজেক্ট হাতে নেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়াই নির্মাণকাজ শুরু হয় পদ্মা সেতুর। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও সক্রিয় হন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরনের ভারসাম্য আনা হয়। তারা অবশ্য নিজেদের দেনা-পাওনাকেই গুরুত্ব দেয়।
২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিরোধীদের সহিংস আন্দোলন মোকাবিলা করা হয় কঠোর হাতে। সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয় আন্তর্জাতিক দুনিয়াও। দমন-পীড়নের কঠোরতায় এক পর্যায়ে রাজনীতির মাঠ থেকে পুরোপুরিই আউট হয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত। এরপর বিরোধীরা এখন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে আর ফিরতে পারেনি। এ কথা বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকই স্বীকার করেন যে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন আইনসম্মত হলেও গণতন্ত্রসম্মত হয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনে দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। এরপরের উপজেলা-পৌরসভা এবং চলতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনগুলোতেও জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। ভোটাধিকার এখন বাংলাদেশে অনেকটাই নির্বাসিত। গণতান্ত্রিক অধিকার আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও সীমিত। তবে একথাও সত্য যে, শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উদীয়মান শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে। জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতারই প্রমাণ। মেগা প্রকল্পগুলো দেশের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও এসেছে বড় সাফল্য। ঢাকার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছিলেন, দেশটা কোথায় ছিল? আর এখন কোথায় এলো। আমরা ভাতের জন্য মানুষকে ‘যুদ্ধ’ করতে দেখেছি। সেদেশ যে এতোটা এগুলো তার কৃতিত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দিতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন গ্র্যান্ড মাস্টার আসলে একজনই। অন্যরা বারবারই পিছিয়ে পড়ছেন চালে। শেখ হাসিনার সামনে আপাতত কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। নানা ইস্যুতে মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। বেশ ওই টুকুই। একসময় নতুন ইস্যু আসে। পুরনো ইস্যু ভুলে যায় মানুষ। বাংলাদেশের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সবস্থানেই এখন শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণ। রাজনীতিতে এখন তার কথাই শেষ কথা। কোথাও তার কোনো চ্যালেঞ্জার নেই।

সূত্রঃ মানব জমিন

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More