হাজার বছরের এক পুরাতন ব্যবসার নাম পতিতাবৃত্তি । বিচিত্র এই দোকানীরাই আমাদের সমাজে পতিতা, গণিকা, বেশ্যা, রক্ষিতা নানাভাবে পরিগণিত হয় । তবে সভ্যতার বিবেচনায় একে অন্ধকার গলি বলা হয়ে থাকে। হয়তো অন্ধকার গলি বলেই আলোর মানুষেরা চেনে না এ গলি, জানে না এ জগৎ । কিন্তু তারপরও সত্য, কৃষ্ণ গহ্বরের মত অস্তিত্বমান এই অন্ধকার গলি । খুব সুনির্দিষ্ট করে হয়তো বা বলা মুশকিল পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কখন কিভাবে উৎপত্তি ঘটেছে বিচিত্র এ ব্যবসার। তবে যতদুর জানা যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার গর্ভে অর্থাৎ সামন্তীয় সমাজের পাপের ফসল এই পতিতাবৃত্তি ।
১। পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সকল নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করতে নিজেদের দেহ দিয়ে আপন জীবিকা উপার্জন করে। পতিতা প্রয়োজনমত নিজেকে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও অলঙ্কারে ভূষিতা রাখে । যেন এক প্রকার পণ্য দ্রব্য । তারা সব সময় মনে করে সৌন্দর্য্য দিয়ে পুরুষকে জয় করতে পারলেই মিলবে তার যাচিত অর্থ । বেশ্যাদেরও ঘটক বা দূত থাকে । তারা অন্য লোককে তার গুণ পণ্য বলে তাকে আকর্ষন করে নিয়ে আসে ।
পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো ইতিহাসের আদিকাল থেকেই ॥ যেমন – দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী,অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু,গণিকা ইত্যাদি । তবে কামসুত্র গ্রন্থের লেখক ‘বাৎস্যায়ন’ পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন, তা হলো – “বেশ্যা বিশেষ প্রকরণ – ‘কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রূপজীবা এবং গনিকা।
ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে আছে – “সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”
‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে – “পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সমপ্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে – জীবিকা অর্জন করে ।” তবে জর্জ রালি স্কট তার বইতে,আরো এক শ্রেনির পতিতার কথা বলেছেন, যারা অর্থ ছাড়াই পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে তাদেরকে তিনি ‘পেশাহীন পতিতা’ বলে অভিহিত করেছেন ।
মানব জন্মের শুরু থেকেই মানুষকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে । কিন্তু সমাজ বিবর্তনের একটি পর্যায়ে এসে নির্দিষ্টভাবে নারী দেহ বিক্রির মাধ্যমে আয়ের একটি ব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। এর নাম পতিতাবৃত্তি যা ঘৃণিত। অথচ স্বীকৃত পেশা হিশেবে আজ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত । অপরদিকে প্রকৃতি মানুষকে যে কয়েকটি সাধারণ জিনিস দিয়েছে যেমন ক্ষুধা, ঘুম, লোভ, দয়া, জৈবিক তাড়না ইত্যাদি । তারমধ্যে সবচেয়ে জোরাল জিনিস হচ্ছে ক্ষুধা ও জৈবিক তাড়না । পুরুষ যখন যৌনক্ষুধা মেটাবার জন্য স্ত্রী ব্যতিরেকে যখন অবৈধভাবে অন্য নারীর সঙ্গে কামনা করে, অন্যদিকে নারী তার অন্ন-বস্ত্রের সংগ্রহের প্রয়োজনে তার দেহদান করতে প্রস্তুত হয় । তখনই একটা আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক একটা অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা হল পতিতাবৃত্তির পেশাগত রূপ, তা সামাজিকভাবে ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে দোষণীয় হোক আর না হোক- এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত । কিন্তু এর বাইরেও অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে পতিতাবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুরুষ আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করবে যেখানে নারীর যৌন চাহিদার প্রশ্ন অবান্তর ।
২। পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। বিশেষত অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন । ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে । সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হতো।
একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নাম। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানেও এই প্রথার চল ছিল ।
‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ যুগে আরবে পতিতাবৃত্তি সহ আরো অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল॥ ইতিহাসবিদ পি.কে হিট্টি বলেন,’মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের একশ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়।’ ঐ যুগে ইমরুল কায়স,তারাকা আমর,লাবীদ, যুহায়ের নামক কবি অশ্লীল কবিতা রচনা করতো । এ ব্যাপারে মাওলানা আকরাম খাঁ তার বইয়ে লিখেছেন,’পুংমৈথুন, স্ত্রীমৈথুন এবং পশু মৈথুন তাদের ভিতর প্রচলিত ছিল এবং তা তারা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করত।’
” প্রাচীন গ্রিস , এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পতিতা বৃত্তি চালু হয়েছিল । এমনকি সেসময় অনেককে বাধ্য করা হতো পতিতাবৃত্তি করতে । ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে বেশ্যা ছিলেন । পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই।
অ্যাথেন্সের আইন প্রণেতা ও কবি সোলোন (খ্রি.পূ. ৬৩৮-খ্রি.পূ. ৫৫৮) যিনি প্রাচীন গ্রিকের তৎকালীন সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন ।
“মহাভারতে উল্লেখ আছে যে,একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে । এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা ‘স্বর্গবেশ্যা’ দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন মিলন করেছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই হলো সেইসব মুনি ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মান জনক বৃত্তি গুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ঐ কারণেই বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছেন – ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, কৌটিল্যর আরেক নাম ছিল চাণক্য । তিনি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রের’রচয়িতা । তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা । পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয় । ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা ।
কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। নগরজীবনের অবশ্যঅঙ্গ ছিল এটি। রাজকোষের আয়ের যে বিভিন্ন উৎস ছিল তার মধ্যে ‘দুর্গ’ নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের যে চিত্র পাওয়া যায় টা নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে ।
প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস প্রথম মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ভারতে এসেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে গণিকারা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যারা দেহব্যবসা করতেন তাদের একটি তালিকা দেয়া আছে– যথা পুংশালী অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী, সুরাসুন্দরী অর্থাৎ পানশালার ওয়েটার, বন্ধকী অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ, বেশ্যা অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর, সাধ্বি-ব্যঞ্জনা অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর, দেবদাসী অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা, পরিব্রাজিকা অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল । এঁদের সামাজিক মর্যাদা ছিল রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম । যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময় রাজার সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন গ্রিক লেখকরা ।
বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৎকালীন গণিকা নারীরা সমাজে-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। তাদেরকে যখন তখন যে কেউ ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারত না কিংবা মন্দ কথা বলতে পারত না। এমনকি গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও অধিকার ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য উপঢৌকন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহমিলনের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হতো।
সে সময় আরো এক ধরনের পতিতাবৃত্তি চালু ছিল ভারতে – ক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি।
অর্থাৎ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌন মিলন। এ ধরনের কাজে যে ব্যাক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী। দেবদাসী মন্দির সেবিকা। বর্ধিত অর্থে মন্দিরের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এখনো গোপনে ভারতের অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা চালু আছে । এছাড়া “উত্তর ভারতে জিপসি সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়ে শিশুকে পতিতা বানানোর এক ধরনের প্রথা ছিল। বিহার ও উত্তর প্রদেশে ছিল নায়েক,পশ্চিম ভারতের গুজরাটে দেহে ও বর্ণের পতিতা এবং দাক্ষিণাত্যে ছিল মোহর নামক উপজাতীয় পতিতা।
” সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর “কাদম্বরী” গ্রন্থে লিখেছেন,সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতো। “নবম শতকে ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থ লিখেছিলেন কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি ‘দামোদর গুপ্ত’। ‘বিকরবালা’ নামের এক বৃদ্ধা বেশ্যার উপদেশ নামা নিয়েই মুলতো ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থ লেখা। বাৎসায়নের কামসূত্রের মতোর ‘কুট্টনীমত’ একটা কামশাস্ত্র গ্রন্থ॥” এছাড়া মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্য গুলিতেও বেশ্যা নারীর উল্লেখ আছে। দোনা গাজির- সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের- লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের- গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস — এইসব কাব্য পুথিতে বেশ্যা- সংস্কৃতির সরস বিবরণ দেওয়া রয়েছে।
বৃটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ঐ সময়। “১৮৫৩ তে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি বেশ্যাগৃহ ছিল যাতে বাস করছিলেন ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৭ তে ছিল ৩০,০০০ জন॥ ১৯১১ সালের আদশুমারি অনুযায়ী ১৪২৭১ জন। ১৯২১ সালের আদম শুমারিতে অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়। [তথ্যসুত্র: দেবাশিস বসু, ‘কলকাতার যৌনপল্লী’, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ,বার্ষিক সংকলন ৫,২০০১]” কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরো বেশী হবে। “কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল বেশ্যাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, চিকিৎসালয়ের পাশে বেশ্যা, মন্দিরের পাশে বেশ্যা। [তথ্যসুত্র: বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত,১৯৯৯, পৃ. ৩০২-০৩]”
“বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স এগুলো ছিল বেশ্যাদের আখড়া॥ [তথ্যসুত্র: বিশ্বনাথ জোয়ারদার, পুরনো কলকাতার অন্য সংস্কৃতি,২০০৯, পৃ. ৩৪-৩৮]” “এমনকি কিছু পতিতা শহরে প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করতো। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ কলকাতার পুলিশ ধনীদের তৈরি বেশ্যালয় গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না । শুধু মাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই তেতাল্লিশটি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন।
আসলে নারীদের সবসময় ভোগের পন্যই মনে করা হয়েছে, ইংরেজ আমলেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না । “বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের, রক্ষিতা ছিল॥ এমনকি ঐ রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন॥ মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। [ তথ্যসুত্র: অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা; ড. আবুল আহসান চৌধুরী : শোভা প্রকাশ]” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন।
নিষিদ্ধ পল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল । যাইহোক এইরকম আরো অনেকেরই আছে তাদের কথা আর নাইবা লিখলাম। “শুধু তাই নয় সেই সময় ইংরেজ সৈন্যরা মাত্রাতিরিক্ত পতিতালয়ে যেতো। যার ফলে ১৮৬০ সালে ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে ৬০% এর বেশী যৌনরোগে আক্রান্ত হয়ে পরে। তাই ইংরেজ সরকার ১৮৬৪ সালে পাশ করালেন – (Cantonment Act) আইন। সেনা ছাউনি গুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য তৈরি হল আলাদা বেশ্যালয়, সেখানে যেসব বেশ্যারা আসতেন তাঁদের রেজিস্ট্রি ভুক্ত করে পরিচয় পত্র দেওয়া হত। যৌনরোগ থেকে তাঁদের মুক্ত রাখার জন্য ‘লক হসপিটাল’ নামে বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয় প্রধান সেনা ছাউনিতে ।
তবে বাংলাদেশের “যশোর শহরে পতিতা বৃত্তির ইতিহাস রয়েছে ৫শ’ বছরের। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই যশোর শহরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি। ব্রিটিশ যুগে যশোর শহরের তিনটি স্থানে পতিতালয় ছিল॥ কলকাতার জমিদার মনমত নাথ রায় ঘোড়া গাড়ি করে প্রতি শনিবার আসতেন ফুর্তি করতে। আর সে সময়ে তাকে মেয়ে সাপ্লাই দিতো চাঁচড়া রায় পাড়ার ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে।
বর্তমান আমাদের দেশে পতিতারা রয়েছে অনেকটা সংজ্ঞাহীন নাগরিক হিসেবে। এক হিসাব মতে দেশে মোট ৭৪৩০০ পতিতা রয়েছে। যার মধ্যে ৩০৭০০ জন ভাসমান পতিতা । আমাদের দেশে এখন সাধারণত চার ধরণের যৌন কর্মী রয়েছে….
ক) যৌনপল্লী বেইজ সেক্স ওয়ার্কার
খ) রেসিডেন্স বেইজ সেক্স ওয়ার্কার
গ) হোটেল বেইজ সেক্স ওয়ার্কার
ঘ) স্ট্রিট বেইজ সেক্স ওয়ার্কার।
যার মধ্যে স্ট্রিট বেইজ কর্মীরা যেমন অসুরক্ষিত তেমনি জড়িত নানা ধরণের অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে।
৩। পতিতাবৃত্তির ইতিহাস যথেচ্ছাই পায়চারী করলে একথা অনুধাবনযোগ্য যে সমাজের আদিম অবস্থায় আজকের মতো পরিবার প্রথা ছিল না । মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করতো। মর্গানের মতে, এক একটা গোষ্ঠীর মধ্যে অবাধ যৌন মিলন চলতো । সেখানে প্রত্যেক পুরুষেরই প্রত্যেক নারীর উপর সমান অধিকার ছিল, আবার প্রত্যেক নারীরও প্রত্যেক পুরুষের উপর সমান অধিকার ছিল । অবশ্য অবাধ যৌন মিলনের স্তর এতই সুদূর অতীত হয়ে গেছে যে বর্তমানে তার শেষ চিহ্নটিও আবিস্কার করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আজকের মানুষ সভ্যতার যে স্তরে পৌঁছেছে তাতে অবাধ যৌন মিলনের স্তর সম্পর্কে বলতে এখন লজ্জা পায় । যাই হোক তারপরেই মানুষ পদার্পণ করেছিল যৌথ বিবাহের যুগে ।
বাকোফেন এ বিষয়ে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করেন এবং ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে এর প্রমাণও হাজির করেছেন। যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় নারীদের প্রাধান্য ছিল। কারণ উক্ত ব্যবস্থায় সন্তানের বাবা কে তা বুঝতে পারা অসম্ভব ছিল, কিন্তু মাকে চিনতে ভুল হত না । সে সময় অনেক দম্পতি তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে একত্রে বসবাস করতো, সেখানে নারী যে ঘর-সংসার দেখাশোনার কাজ করতো তা পুরুষের খাদ্য সংগ্রহের কাজের সমান সামাজিক প্রয়োজন বলে বিবেচিত হত। তারপর মানব পরিবারের ক্রমবিকাশের পরবর্তী স্তরে আর যৌথ পরিবার প্রথা টিকলো না। যৌন সম্পর্কের আওতা থেকে প্রথমে নিকটতম লোকদের তারপর একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের বাদ দিতে থাকায় যৌথ পরিবার প্রথা লোপ পেল । অবশেষে একজোড়া নর-নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল পরিবার। বিশ্বের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসমূহের পারিবারিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে এখনও এসব তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় । বলা যেতে পারে যে একবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের পিছনে নিয়ামক হিসেবে প্রধান ভূমিকা ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ।
পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অর্থাৎ সম্পত্তির উপর যৌথ অধিকারের স্থলে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং অবাধ যৌন মিলনের যুগে এবং যৌথ পরিবারের যুগে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না । লিঙ্গ বৈষম্য শুরু হয়েছে পুরুষরা যখন থেকে একচেটিয়া সম্পত্তির মালিক হয়েছে এবং তখন থেকেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার প্রচলনও ঘটেছে । উহাই ছিল নারী জাতির ঐতিহাসিক মহা পরাজয় । সে সময় থেকেই ঘর সংসারের কাজকে আর সামাজিক কাজ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, সাংসারিক কাজকর্মগুলো তখন হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত বিষয়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও তা মূল্যায়িত হয় না । স্ত্রী হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক দাসী, বঞ্চিত হয় ধনসম্পদের মালিকানা থেকে। ঠিক ওই সময় থেকেই মেয়েদেরকে নামানো হয়েছে বেশ্যাবৃত্তিতে, যা সম্পূর্ণভাবে পুরুষ আধিপত্যের দ্বারা সৃষ্ট ।
পুরুষ যখন চেয়েছে উত্তরাধিকারী হিসেবে তার সম্পদ যেন নিজের নির্দিষ্ট সন্তান ছাড়া আর কেহ না পায়, তখনই তারা একবিবাহ প্রথার প্রবর্তন করেছে। কাজেই শুরু থেকেই একবিবাহ বাধ্যতামূলক শুধু নারীর জন্যে, মোটেই তা পুরুষের জন্যে নয়। দলগত বিবাহ প্রথার যৌন স্বাধীনতা শুধু নারীরাই হারালো, পুরুষদের বেলায় তা হলো না। ফলে তখন থেকেই পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রীর রাখার বৈধতার পাশাপাশি গোপনে বা প্রকাশ্যে বহুপত্নী ব্যবহারে অথবা বেশ্যার ব্যবহারের প্রচলন চলে আসছে । ঘরের স্ত্রীর যৌনাঙ্গে লোহার বেড়ি পরিয়ে তালাবদ্ধ করে আটকিয়ে রেখে পুরুষের বিভিন্ন যায়গায় যৌনকর্ম করে বেড়ানোর ইতিহাস বেশি দিনের পুরোনো নয়। বাস্তবিক পক্ষে পুরুষদের ক্ষেত্রে আজও কিছুটা দলগত বিবাহ প্রথা বিদ্যমান, যা নারীর জন্য নয়। তাই একাধিক পুরুষের সাথে নারীর যৌনতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং যার জন্য আইনের দৃষ্টিতে, ধর্মীয় রীতিতে এবং সমাজের কাছে তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয় অপরপক্ষে পুরুষের ক্ষেত্রে তাহলো সম্মানের কাজ, যদিও কোনো কোনো সময় উহা পুরুষের নৈতিক পদস্খলন হিসেবে দেখা হয় তবে হাসি মুখেই তা মেনে নেয়া হয় । একই কারণে অভিধানে ‘পতিতা’ শব্দটি থাকলেও ‘পতিত’ নামক কোনো শব্দ নেই এবং থাকার কথাও নয়।
সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে ইহাই প্রতিষ্ঠিত এবং বাস্তব সত্য এই যে, যখন থেকে একবিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে তখন থেকেই স্ত্রীর পাশাপাশি বেশ্যারও সৃষ্টি হয়েছে। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন, “বেশ্যাদের থেকে সেই স্ত্রীর পার্থক্য কেবল এই যে, সে সাধারণ বেশ্যাদের মতো রোজই নিজের দেহকে দিন-মজুরের মতো ভাড়া খাটায় না, কিন্তু তার দেহকে সে একেবারেই চিরকালের দাসত্বে বিক্রি করে দেয়।” কিন্তু এত কিছুর পরেও সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে, একবিবাহ প্রথার উদ্ভব ছিল সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে একধাপ অগ্রগতি । তাই এঙ্গেলসও মনে করতেন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে প্রেমময় এবং মধুর, থাকবে না কোনো লিঙ্গ-বৈষম্য ।
যাইহোক পতিতাবৃত্তি চলে আসছে লক্ষাধিক বছর পূর্বে থেকে এবং ধর্মগুলি এসেছে মাত্র দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে । লক্ষ্য করার বিষয় এই যে যদিওবা কোন ধর্মই এই ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন না করে এসেছে তবুও সময়ের আবর্তে কখনো ক্রীতদাসীর সাথে যৌনকর্মের পক্ষে কিংবা নারীর দেহ বিক্রয় করার অর্থ মন্দিরের তহবিলে জমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর্মেনিয়ার আনাইতিস দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসীরা, করিন্থের আফ্রোদিতে দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসীরা, ভারতীয় মন্দিরসমূহের নর্তকীরা, পর্তুগীজ বায়াদের নর্তকীরা এক সময় ছিল দুনিয়ার সেরা বেশ্যা । এভাবে যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি ।
এক কথায় বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্যের এক চরম শোচনীয় পরিণতির নাম হচ্ছে পতিতাবৃত্তি । বাংলাদেশেও সেই ধারাবাহিকতা যথারীতি চলে আসছে বহুবছর ধরে । এদেশে বহু পতিতালয় ছিল এবং এখনও বেশ কিছু রয়েছে । তবে শঙ্কার বিষয়, পতিতালয়ের সংখ্যা দিন দিন কমলেও পতিতার সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলছে ।