মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আমতৈল গ্রামের পালপাড়ার তৈরি মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিল জেলা জুড়ে।
মাটির তৈরি ভাতের হাঁড়ি, মুড়ি ভাজা হাঁড়ি, রুটি বানানোর তাওয়া, ধোয়া-মোছার কাজে মালসা, পানির কলস গৃহবধূদের কাছে ছিল বেশ জনপ্রিয়। কেনার আগেই ফেরিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করা হতো মানিকদিহি’র হাঁড়ি তো?
আমতৈল গ্রামেরই অপর নাম মানিকদিহি।
কালের বিবর্তনে প্লাস্টিক, ষ্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের ভিড়ে সে কদরে ভাটা পড়েছে অনেক আগেই। ফলে জীবন জীবিকার তাগিদে অনেকেই পেশা বদলেছেন। তারপরও প্রায় অর্ধ শতাধিক পরিবার বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে না পেরে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েও নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন এ পেশার সাথে।
আজ দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত পালপাড়ার কুমাররা। ভালো নেই মেহেরপুর সদর উপজেলার চাঁদবিল এবং মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের কুমার পরিবারগুলো।
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরের নিভৃতপল্লী আমতৈল। গ্রামের একটি অংশের নাম পালপাড়া (মানিকদিহি)। বর্তমানে শতাধিক পাল পরিবার এখানে বসবাস করে।
বয়সের ভারে ক্লান্ত পালপাড়ার জগন্নাথ পাল (৬৮) অভাবের মধ্যে আজও বাপ-দাদার পেশা নিয়ে বেঁচে আছেন। নিপুণ হাতে তৈরি করছেন নানা তৈজসপত্র।
তিনি বলেন, ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি এখানে মাটির মায়ায় জড়িয়ে আছেন। পেশা বদলাতে পারেননি। তবে সংসার আর চলছে না। তাই এর পাশাপাশি সিমেন্ট বালির রিং স্লাবও তৈরি করছেন।
জগন্নাথ পালের স্ত্রী সমিতা পাল (৬৩) জানান, কিশোর বয়সে মনের অজান্তেই বাবা-মা’র দেখাদেখি এই পেশার সাথে জড়িয়ে পড়েন। সংসারে ৬ মেয়ে আর ২ ছেলে। জমি জায়গা কিছুই নেই।
পালপাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ কুমার হিসেবে পরিচিত চৈতি পাল (৭৮) ও তার স্ত্রী কারুলী বালা এখন আর বয়সের ভারে একাজ করতে পারেন না। দু’বছর আগেও চৈতি পাল মাটির পাত্র তৈরি করতেন আর আধা শুকনো হলে তাতে নানা রকমের নকশা দিতেন স্ত্রী কারুলী বালা। পালদের কাজে নিপুণতা ও সৌন্দর্য থাকলেও চেহারায় জৌলুস নেই। দেহে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ-ব্যাধি। চৈতি পালের দু’ছেলে উত্তম ও জিতেন পেশা বদলে এখন নরসুন্দরের কাজ করেন।
গোটা পালপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, পরিকল্পিত পরিবার কিংবা স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই কম। এখনও খোলা মাঠে প্রাকৃতিক কাজ সারে তারা। রোগ-ব্যাধি হলে কবিরাজ কিংবা বৈদ্যের স্মরণাপন্ন হয়। বাল্য বিয়ের প্রচলনও আছে সেখানে।
কুমাররা জানান, আগে মাঠ-ঘাট থেকে এমনিতেই মাটি পাওয়া যেত, কিন্তু এখন মাটি কিনতে হয়। বেড়েছে মাটি কেনাসহ আনুসাঙ্গিক জিনিসের দামও। ফলে হাঁড়ি-পাতিল তৈরিতে আগের তুলনায় খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ। সে তুলনায় তৈরি জিনিস পত্রের দাম বাড়েনি। তাছাড়া গৃহীনিদের চাহিদা এখন প্লাস্টিক ও এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বাহারি জিনিসপত্রের প্রতি।
আনন্দ পাল জানালেন ভিন্ন কথা। মাটির তৈরি অন্যান্য জিনিসের কদর কমলেও বেড়েছে পোড়া মাটির রিং এর চাহিদা। স্বল্প খরচে পায়খানার ট্যাংকি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে এই রিং দিয়ে। যেখানে ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে একটি ট্যাংকি তৈরিতে ব্যয় হয় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। সেখানে তাদের রিং দিয়ে সমপরিমাণ ট্যাংকিতে খরচ হয় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। যার কারণে মানুষের কাছে রিং এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক।
তিনি বলেন, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের কদর কমলেও বেড়েছে পোড়া মাটির তৈরি বিভিন্ন প্রকারের গৃহসজ্জার সরঞ্জাম আর শোপিচের কদর।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চাহিদা সম্পন্ন-পোড়া মাটির সরঞ্জাম তৈরির প্রশিক্ষণ এবং বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করা গেলে আবারও তারা ফিরে পাবে হারানো দিন -এমনটিই আশা পালপাড়ার কুমারদের।