চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপসহ নানা কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ সময় বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক ঘরে করে রাখা হবে। লক্ষ্য অর্জনে প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয়ভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। চলবে হরতাল, অবরোধ ও নাশকতাবিরোধী জনমত গঠনের কাজও।
ইতিমধ্যেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকান্ডকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে দেশ বিদেশে উপস্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। বিরোধীজোটকে আরো বিভ্রান্ত করতে খুব শিগগিরই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সঙ্কট নিরসনে সংলাপ প্রস্তাব দেয়া নাগরিক উদ্যোক্তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। তবে স¤প্রতি শুরু হওয়া জোরালো ক’টনৈতিক তৎপরতার বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান হরতাল-অবরোধে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও হাল ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সুশীল সমাজ, কূটনৈতিকদের উদ্বেগ ও সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর চাপেরও শেষ দেখতে চায় দলটি। সেজন্য দুই/ চার দিন, এক সপ্তাহ বা পনেরো দিন এসব রোডম্যাপ বাদ দিয়ে এখন দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোচ্ছেন দল ও সরকারের নীতি নির্ধারকরা।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা জানান, বিএনপির রাঘববোয়াল পর্যায়ের সব নেতা গা ঢাকা দিলেও নিজ নিজ এলাকার কেউ কেউ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনায় মদদ দিচ্ছেন। তাদের আটক করতে পারলেই অগ্নিবোমা ছোড়ার মতো নৃশংস ঘটনা আর ঘটবে না। এ ছাড়া বোমা মারতে মারতে সরকারবিরোধীরা এক সময় ক্লান্ত হয়ে আপনা আপনিই থেমে যাবে। এতে এক পর্যায়ে সব কিছু ¯^াভাবিক হয়ে আসবে। এজন্য যতো সময় লাগে আইনশৃক্সখলা বাহিনী মাঠে থাকবে। আর কাক্সিখত লক্ষ্য অর্জনে সরকার নানা কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্য এক নেতা বলেন, পাকিস্তানে এতো জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সত্বেও ওই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়েও বেশী। তাই এসব জঙ্গী হামলা অব্যাহত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই।
রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গী’ হিসেবে উপস্থাপন: দেশব্যাপি চলমান রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গী’ হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে চলছে সিডি ও ডিভিডিসহ তথ্যচিত্র নির্মানের কাজ। তথ্যচিত্র তৈরি হলে তা বিদেশী দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও সংস্থায় সরবরাহ করা হবে। লাগাতার অবরোধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে জাতিসংঘসহ বিদেশীদের আনুকুল্য পেতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে দেশব্যাপি চলা সহিংসতার ভিডিও চিত্র নির্মাণ করে একইভাবে বিদেশী দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাসহ সারা দেশে মাঠ নেতাদের কাছে সরবরাহ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সংলাপের উদ্যোক্তাদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপন: চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী জোটের সাথে আপাতত কোনো ধরণের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় এ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। সেজন্য সুশীল সমাজের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে উল্টো তাদের প্রত্যক্ষ সমালোচনায় মেতেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ দল ও সরকারের সিনিয়র নেতা মন্ত্রীরা।
সুশীল সমাজকে এক এগারোর কুশীলব আখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে, সুশীল সমাজ নামধারী এসব ব্যক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছেন। তাই তাদের সংলাপ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামানো: পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামাচ্ছে সরকার। নীতি নির্ধারকদের মতে, এ অবস্থা বেশী দিন চলতে থাকলে এক সময় আইন শৃক্সখরা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে দলীয় নেতাকর্মীরাও ঝিমিয়ে পড়বে। সেজন্য শুধু প্রশাসনের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে দলীয় রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামানো হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সব এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। পাড়া মহল্লায় নেতাকর্মীদের দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করতে আগামী মার্চের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোর সম্মেলনের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। খুব শিগগিরই ঢাকা মহানগরের বিভক্ত কমিটি ঘোষনার সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
জনমত গঠন: আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধে রাজনৈতিক কর্মীর চেয়ে সাধারণ মানুষই বেশি ¶তিগ্র¯— হয়েছেন। সেই অনুভূতি কাজে লাগিয়ে পোস্টার, লিফলেট, ইন্টারনেট ও সভা-সমবেশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপিবিরোধী প্রচারণা চালানোর সিদ্ধাš— হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা বিভক্ত হয়ে ওই প্রচারণায় অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে রাজধানীসহ দেশজুড়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। শিগগিরই মহানগর, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক আরো কিছু কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে সহিংসতার শিকার এলাকাগুলোতে সভা, সমাবেশের মাধ্যমে ওই প্রচারণা বেশি চালানো হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন: চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপিজোটের আন্দোলনের মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ক’টনৈতিক তৎপরতায় নজর: তবে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও আš—র্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একের পর এক বিবৃতিসহ নানামুখী তৎপরতা নিয়ে খানিকটা অ¯^¯ি— তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিতে। সরকারের মন্ত্রী ও দলের বিভিন্ন নেতারা বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে মুখে যাই বলেন না প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন। দলের মধ্যমপন্থী নেতারা কূটনৈতিক চাপকে আমলে নেয়ার পরামর্শ দিলেও তা নাকচ করে দিয়েছে অপেক্ষাকৃত কট্ররপন্থী নেতারা। এসব আমলে না নিয়ে একতরফা নীতিতেই এগিয়ে যাওয়ার প¶েই মত ওই প¶টির।
তবে সিনিয়র নেতাদের মতে, ক’টনৈতিকদের নতুন এ দৌড়ঝাপের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, প্রতিদিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির যে হানাহানির চিত্র প্রকাশ হচ্ছে তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। শুরুতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হলেও দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। এর শেষ কোথায় তা কেউ অনুমান করতে পারছে না। জাতিসংঘসহ অন্যান্য মহল বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সত্যিকারের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে তা সরকারের সব পরিকল্পনা মাটি করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই ক’টনীতিদের এই দূতিয়ালি কতদূর গড়াতে পারে সেটি পর্যবেক্ষণ করছে সরকার।