‘ফ্রি ইন্টারনেট’ সেবার নামে রবির প্রতারণা

0

Robiবিশ্বজুড়ে বিতর্কের মধ্যে থাকা ‘ইন্টারনেট ডট ও আরজি’র মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের গ্রাহকদের জন্য ২৮টি সাইটে ফ্রি ব্রাউজিং শো চালু করেছে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি। রোববার স্থানীয় একটি হোটেলে এ সেবার উদ্বোধন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তবে এ সেবাকে ‘ফ্রি ইন্টারনেট’ হিসেবে উল্লেখ করায় শুরুতেই বিতর্কের মুখে পড়েছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রি ইন্টারনেটের নামে ফ্রি ব্রাউজিং সুবিধা দিয়ে সেখানে গ্রাহকদের ‘পে পার ইউজের’ প্রতারণার ফাঁদে ফেলারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তারা বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করা হলে তাতেই সাধারণ গ্রাহক উপকৃত হতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ফ্রি ওয়াই-ফাই সেবা চালুর মাধ্যমেও ইন্টারনেট সেবাকে সহজলভ্য করা সম্ভব।

প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, করপোরেটের ফ্রি সেবা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে গ্রাহকদের গলায় ছুরি চালানোর আরেকটি আয়োজন। ফ্রি ইন্টারনেট দেওয়ার কথা বলে নিজেদের বিজ্ঞাপন এবং চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যকেই বিস্তৃত করছে। এর ফলে মৌলিক অধিকার হিসেবে ইন্টারনেট স্বীকৃত হওয়ার যে দাবি, তা উপেক্ষিত হয়েছে। রবি যে সেবা চালু করেছে, সেখানেও রবির গ্রাহকরা রবির সিমকার্ড ব্যবহারের পয়সা দিয়েই কিছু সাইটে ব্রাউজ করার সুবিধা পাবেন মাত্র। এর অধিক কিছু নয়। এটাকে ফ্রি ইন্টারনেট বলা যায় না। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ডট ওআরজি বিতর্কিত হয়েছে। যে কারণে ভারতে এটি বর্জন করা হয়েছে। কোনো দেশেই সরকার এর সঙ্গে যুক্ত হয়নি।

বাংলাদেশে সরকার কেন এ ধরনের বিতর্কিত উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হলো, তার কারণ অনেকেই বুঝতে পারছেন না। ইন্দোনেশিয়ার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ওয়েবসাইট টেক ইন সিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে মালয়েশিয়ার অজিয়াটা (রবির মূল প্রতিষ্ঠান) লিমিটেড পরিচালিত এক্সএল অজিয়াটা ইন্দোনেশিয়ায় উদ্যোগ নিয়েও সেটি চালু করেনি। এর কারণ হিসেবে এক্সএল অজিয়াটার চিফ ডিজিটাল সার্ভিস অফিসার অসিয়াতার বক্তব্য উদৃব্দত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত ইন্টারনেট ডট ওআরজির সেবাটি বিশ্বজুড়ে বিতর্কের মধ্যে রয়েছে এবং এ সেবার মাধ্যমে গ্রাহক ব্রাউজিং সুবিধা পেলেও ডাটা ট্রান্সফারের সুবিধা পাবেন না, ফলে ভবিষ্যতে নতুন বিতর্ক উঠতে পারে। এ কারণেই সেবাটি চালু করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (কমিউনিকেশন অ্যান্ড করপোরেট রেসপনসিবিলিটি) ইকরাম কবীর এই প্রতিবেদককে বলেন, অজিয়াটা রবি এবং এক্সএলের মূল প্রতিষ্ঠান হলেও বিভিন্ন দেশে অজিয়াটার স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতি ও সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারণ হয়ে থাকে। এক্সএল অজিয়াটার সিদ্ধান্তের সঙ্গে রবি অজিয়াটার কোনো সম্পর্ক নেই।
রবির ফ্রি ব্রাউজিং সেবা যেভাবে: সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ফ্রি ব্রাউজিং সেবা উপভোগ করার জন্য রবির গ্রাহকদের প্রথমে গুগল প্লে স্টোর থেকে ইন্টারনেট ডট ওআরজি অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। ডাউনলোড হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যাবে। এর পর এই অ্যাপ চালু করলে তালিকায় থাকা সাইটগুলো বিনা খরচে ব্রাউজ করা যাবে। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, রবির গ্রাহকরা বিনা খরচের বাইরে যদি কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করতে চান, তাহলে সাধারণ ইন্টারনেট চার্জ প্রযোজ্য হবে। গ্রাহক কোনো ডাটা প্যাক কিংবা রবির নির্ধারিত প্যাকেজ না কিনে ভিডিও কনটেন্ট দেখতে চান, তাহলে পে পার ইউজ ভিত্তিতে চার্জ প্রযোজ্য হবে। সংবাদ সম্মেলনে রবির সিইও সুপুন বীরাসিংহে, চিফ অপারেটিং অফিসার মাহতাবউদ্দিন আহমেদ, চিফ করপোরেট অ্যান্ড পিপল অফিসার মতিউল ইসলাম নওশাদ গ্গ্নোবাল অপারেটর পার্টনারশিপের পরিচালক মারকু মাকেলেইনেন উপস্থিত ছিলেন।
আসল চিত্র: ইন্টারনেট ওআরজির পদ্ধতি এবং রবির সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, ফ্রি ব্রাউজিং সুবিধায় রবির গ্রাহকরা শুধু একটি সাইট দেখা ছাড়া ইন্টারনেটে কোনো ধরনের ডাটা ট্রান্সফার করতে পারবেন না। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের ডাউনলোড, ভিডিও সাইটে অনলাইনে ভিডিও দেখা কিংবা অনলাইনে অডিওতে গানও শুনতে পারবেন না। অর্থাৎ ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় সাইট আদৌ ফ্রি ব্রাউজিং সুবিধার আওতায় থাকবে না। এমনকি ই-মেইলে কোনো ফাইলও পাঠানো যাবে না। ডাউনলোড, ভিডিও কিংবা অডিও কনটেন্ট উপভোগের জন্য অবশ্যই পৃথক মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক না বুঝে কোনো নির্ধারিত প্যাকেজ ছাড়াই ফ্রি ব্রাউজিং সাইট থেকে কোনো ভিডিও কনটেন্ট দেখতে চান, তাহলে তাকে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত মূল্যের বোঝা কাঁধে নিতে হতে পারে।
রবির ওয়েবসাইটে দেওয়া ইন্টারনেট প্যাকেজে পে পার ইউজের মূল্য প্রতি কিলোবাইট দেড় পয়সা। এখন কোনো গ্রাহক এক মেগাবাইটের ফাইল ডাউনলোড কিংবা অনলাইনে প্লে করলে তাকে পরিশোধ করতে হবে ১৫ টাকা। যদি ফাইলটি ১০০ মেগাবাইটের হয়, তাহলে পরিশোধ করতে হবে এক হাজার ৫০০ টাকা। যদি ফাইলটি এক জিবি কিংবা এক হাজার মেগাবাইটের হয়, তাহলে পরিশোধ করতে হবে ১৫ হাজার টাকা। অথচ রবির নির্ধারিত ইন্টারনেট প্যাকেজে এক জিবির বর্তমান মূল্য মাত্র ২৭৫ টাকা। এটা স্পষ্ট, একজন গ্রাহক না বুঝে ফ্রি ব্রাউজিং সাইটে গিয়ে পে পার ইউজের ফাঁদে পড়লে মুহূর্তেই তার সিমকার্ডের অ্যাকাউন্টের অর্থ পুরোটাই হাওয়া হয়ে যাবে। এদিকে রবির একাধিক গ্রাহক রোববার প্রতিবেদককে জানান, ফ্রি ব্রাউজিং সাইটগুলোতে ইন্টারনেটে অস্বাভাবিক ধীরগতি পাওয়া যাচ্ছে।
রবির ফ্রি ব্রাউজিং সুবিধা বাংলাদেশে প্রথম নয়। বাংলাদেশে এর আগেও একাধিক মোবাইল অপারেটর, উইকিপিডিয়ার মতো সাইট ইন্টারনেট ডট ওআরজির ব্যবহার ছাড়াই নিজেদের গ্রাহককে ফ্রি ব্রাউজিংয়ের সুবিধা অনেক আগেই চালু করেছে এবং এখনও দিচ্ছে।

সমকাল

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More