ঢাকা: বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রচার বন্ধ করার দাবি দীর্ঘদিনের। নানা শ্রেণী-পোশার মানুষ এ দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে। এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি সরকার। তবে সম্প্রতি বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধের জন্য দাবি উঠেছে বেশ জোরেসোরে।
গত ৭ আগস্ট বাংলাদেশে স্টার জলসা, স্টার প্লাস ও জি বাংলা- এই তিনটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে আইনজীবী সৈয়দা শাহীন আরা লাইলীর পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূইয়া। এই রিট আবেদনটি বেশ আলোচিত হয় এবং রিটকারিকে সাধুবাদ জানান অনেকেই।
১০ আগস্ট আবেদনটি শুনানির জন্য হাইকোর্টে একটি দ্বৈত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে বলে জানানো হয়।
রিট দায়ের করার আগে ৩ আগস্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করতে বিবাদীদের প্রতি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রচার বন্ধ না হওয়ায় জনস্বার্থে রিটটি করা হয়। আবেদনে বিবাদী করা হয়েছে তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও আইজিপিকে।
স্টার জলসায় ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিরিয়ালে ‘পাখি’ চরিত্রে অভিনয়কারীর মতো পোশাক ঈদের সময় কিনতে না পেরে বাংলাদেশি তিন তরুণী আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকেই ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের দাবিটা আবার শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামালোচনার ঝড় বয়ে যায় এ নিয়ে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করা কি ঠিক হবে? কেন বন্ধ করা প্রয়োজন এ টিভি চ্যানেলগুলো। বিকল্প কোনো পথ আছে কী? এসব বিষয় জানতে কথা হয় বাংলাদেশের বেশ কজন নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে। আসুন জেনে নেই কী বললেন তারা।
‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি’
আবুল হায়াত [অভিনেতা ও নির্মাতা]
ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আমাদের দেশে প্রদর্শনের মতো এতটা উদার হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে একটা নাটক নির্মাণ করতে ২ লাখ টাকা খরচ করা হয়। অথচ ভারতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করে এক একটি নাটক নির্মাণ করা হয়। আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা থাকায় আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না। তাই তাদের চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে প্রদর্শন না করাই ভালো। আমাদের পক্ষে রাস্তায় নেমে এ বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত এ বিষয়টির সুরাহা করা। সবকিছুর শেষ কথা হলো- আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
‘শিল্প বাঁচলেই আমরা বাঁচব’
আলী যাকের [অভিনেতা]
শিল্পকে কখনও আবদ্ধ করে রাখা যায় না। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রদর্শনের কোনো উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না। আবার আমরাও তাদের চ্যানেলগুলো বন্ধ করতে পারছি না। এ পরিস্থিতিতে সবাইকে বুঝতে হবে শিল্প বাঁচলেই আমরা বাঁচব। ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি থাকা উচিত। কী দেখানো যাবে, আর কী দেখানো যাবে না। পাশাপাশি ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রদর্শনের জন্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
‘ভারতীয় সিরিয়াল না দেখলে অনেকের ঘুমই আসে না’
শম্পা রেজা [অভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী]
আমি সবসময়ই মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে। তাই ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রদর্শন বন্ধ না করে, আমাদের চ্যানেলগুলো সেখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ আপনি ইচ্ছা করলেই কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারেন না। আমাদের দর্শক ভারতীয় অনুষ্ঠান দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অনেকের তো ভারতীয় সিরিয়াল না দেখলে ঘুমই আসে না। তাই সবার স্বার্থ রক্ষায় কোনো কিছু বন্ধ না করে তা উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত।
‘আমরা এখন পর্যন্ত তাদের গোলামী করছি’
রোকেয়া প্রাচী [অভিনেত্রী]
ভারতীয় তিনটি চ্যানেল বন্ধের জন্য যিনি রিট করেছেন তিনি সাহস বা দুঃসাহস দেখিয়েছেন। এটা তার ব্যাপার। তবে আমাদের চ্যানেল ভারতে দেখানো হয় না এটাই মূল বিষয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় সরকারে পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। আমি বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক বলতে বুঝি ছাড় দেয়ার মানসিকতা, বিভিন্ন বিষয়ে আদান প্রদান ও লেনদেন। যা এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে নেই। তাই আমরা শিল্পী সমাজ ওদের দেশে আমাদের সাহস দেখাতে চাই। আমাদের চ্যানেলগুলো ভারতে উন্মুক্ত করে দেয়া হোক।
আমি এর আগে ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলের অবাধ প্রদর্শনের জন্যে ঢাকায় একটি সমাবেশ করেছিলাম। যেখানে শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত তাদের গোলামী করছি। তাই যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, যারা আমাদের চেতনায় বিশ্বাসী তাদের উচিত এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা।
‘ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক’
গিয়াস উদ্দিন সেলিম [চলচ্চিত্র নির্মিতা]
কোনো চ্যানেল বন্ধ করার পক্ষপাতি আমি নই। কারণ পৃথিবী এখন খুলে গেছে। এই সুযোগে ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের চ্যানেলগুলোকে মেরে ফেলছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না। তাই আমার দাবি, এদেশে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রদর্শন বন্ধ না করে ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক।
‘আমাদের ব্যবসায়ীরা শুধু নিজের লাভের কথাই চিন্তা করে’
নূরুল আলম আতিক [চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক]
কোনো কিছু বন্ধ করার দলে আমি নাই। কিন্তু যেখানে আমাদের একটিও টিভি চ্যানেল দেখানো হয় না, সেখানে আমরা ভারতের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেলকে আমাদের দেশে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমার প্রশ্ন এটা কার সিদ্ধান্ত? ভারতের ব্যবসায়িক মহল পুরো ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থটা দেখে বলেই, আমাদের চ্যানেলগুলো সেখানে প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা শুধু নিজের লাভের কথাই চিন্তা করে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষই নিজের ভাষায় নাটক চলচ্চিত্র দেখতে চায়। কিন্তু আমরা অপরেরটা দেখতে চাই। এটা আমাদের জন্যে আত্মগ্লানির বিষয়। দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলও দর্শকদের কথা ভাবে না। সবাই নকল ও বস্তাপচা অনুষ্ঠান ও নাটক নির্মাণ করে। তাই লোগো না থাকলে সবগুলোকে একই চ্যানেল মনে হয়। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশে চাইনিজ চ্যানেল এসে হাজির হবে। আমরা বাংলার সঙ্গে চাইনিজ ভাষা মিশিয়ে কথা বলব।
‘প্রয়োজনে আমরা সবাই রাস্তায় নামব’
তানভীন সুইটি [অভিনেত্রী]
প্রথমত একজন শিল্পী হিসেবে আমি কখনই চাই না বিদেশি চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে চলুক। তবে বিদেশি চ্যানেলগুলো এরইমধ্যে আমাদের কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। অথচ যখন দেশের বাইরে আত্মীয় স্বজনদের কাছে বেড়াতে যাই, তখন দেখি তারা বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোই দেখছে। তাই আমার কাছে সবার আগে আমার দেশ। এমন কিছু অবশ্যই করা উচিত না, যাতে আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটা সময় কলকাতার লোকেরা আমাদের নাটক দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকতো। অথচ এখন সবকিছু উল্টে গেছে। তাই আমাদের এই শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজনে আমরা সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নামব।
দেওয়ান পারভেজ, বাংলা মেইল ২৪