এরকম ধারণা সমাজে এখন বেশ জোরদার যে, ভারত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সকল সমর্থন প্রদান করেছে, তারা তাদের গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবধরনের প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে আগের চাইতে অনেক বিস্তৃতভাবে নিয়োজিত করেছে। সেকারণে দেশ ও বিদেশের সকল মত অগ্রাহ্য করে সরকার একতরফা নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। এতো বাধাবিপত্তির মধ্যে এরকম নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য যে মনোবল দরকার ছিলো তার অন্যতম যোগানদার ভারত। ভারতের সাহসেই এটা সম্ভব হয়েছে। সফলভাবে সরকারও গঠিত হয়েছে। ভারত শুধু যে সমর্থন দিয়েছে তাই নয়, অন্যদের সমর্থন আদায়ে প্রভাবও খাটিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী আর বিএনপি ভারতবিরোধী এরকম সরল সিদ্ধান্ত সমাজে বেশ শক্তভাবে বিরাজ করলেও বিষয়টি এতো সরল নয়। ভিন্ন অনেক বিষয়ও আছে। কারণ বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় নীতি ও দুর্নীতির পথ গ্রহণে বিএনপি-জামাত কখনোই কার্পণ্য করেনি। যে কারণে বিএনপির শাসনামলে ভারতের বিনিয়োগ ও বাজার বৃদ্ধির রেকর্ড আওয়ামী আমলের চাইতে কম নয়। মার্কিন কোম্পানির কর্তৃত্বে ভারতে বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি, বিপজ্জনক টাটা প্রকল্প এসবগুলোতেই চারদলীয় জোট সরকারের প্রবল আগ্রহ আমরা দেখেছি। জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে জনপ্রতিরোধের কারণেই বাংলাদেশ তখন বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
তাছাড়া এটা মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি যে নীতি সংস্কার এদেশে পরিচালনা করে তার প্রত্যক্ষ সুফলভোগী ভারতের বৃহৎ পুঁজি। পশ্চিমা বহুজাতিক পুঁজির সাথে এই পুঁজি এখন জৈবিকভাবে যুক্ত। সুতরাং যারা বিএনপি জামায়াতের মতো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ অনুসারী,তাদের মুখে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ভারতের বিরোধিতার বাগাড়ম্বর শোনা যেতে পারে, কিন্তু তাদের নীতি ও পদক্ষেপ আখেরে ভারতের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থই রক্ষা করে। এর থেকে ভিন্ন কোন ভূমিকা গ্রহণ বাংলাদেশের লুটেরা শাসক শ্রেণীর কোন দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাহলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে ভারত মরিয়া এই ধারণা সমাজে তৈরি হচ্ছে কেনো? তৈরি হয়েছে আরও অনেক কারণের সাথে ভারত সরকারের কতিপয় মন্ত্রী,মিডিয়া এবং বাংলাদেশের সরকারের বিভিন্নজনের বক্তব্য ও ভূমিকা থেকে। একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত: হিন্দু পত্রিকার সঙ্গে আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ (৩০ ডিসেম্বর ২০১৩)। তাঁর কথার সুর এরকম যে, বাংলাদেশ নিয়ে যথাযথ ভূমিকা নির্ধারণের এখতিয়ার ভারতেরই আছে। ভারতের অবস্থান অনুযায়ীই অন্যদের ভূমিকা গ্রহণ করা উচিৎ!
সেজন্য প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি এখন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ নানা বৃহৎ শক্তির ভাগবাঁটোয়ারার ক্ষেত্র? ভারত কি বাংলাদেশকে পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়? বাংলাদেশকে কি ভারত তার উপগ্রহ বানাতে চায়? বাংলাদেশ কি ভারত হয়ে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখবে? অন্যান্য দেশকে কি ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করতে হবে? শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের সমঝোতা কি এরকম যে, ভারত যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখবে আর তার বিনিময়ে ভারতের চাহিদা পূরণে যা যা দরকার তা বিনা প্রশ্নে বাস্তবায়ন করবে এই সরকার? গত কয়েকবছরে সরকারের ভূমিকা এসব প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ যুক্তিকে সমর্থন করে। সীমান্ত হত্যা, কাঁটাতারের বেড়া, ছিটমহল, টিপাইমুখ, ট্রানজিট, নদীর পানিবন্টন চুক্তি ইত্যাদি নিযে সরকারের ভূমিকা এমনকি কতিপয় মন্ত্রীদের বক্তব্য থেকে সবসময়ই মনে হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের চাইতে ভারতের শাসকদের স্বার্থ দেখার দায়িত্বই যেনো তাদের বেশি। মনে হয়েছে ভারত কখন বিরক্ত হয় সেটা নিয়েই তাদের উদ্বেগ।
অনেকের মুখে শুনি, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এদেশের ‘মৌলবাদী জঙ্গী’ দমনের জন্য খুবই দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য তৈরির পেছনেও একই যুক্তির কথা শোনা যায়। এই যুক্তি কিংবা অজুহাতে ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানারকম চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, মহড়া ও আয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের’ ফ্যাসিবাদী যুগে বাস করছি। এই মডেল পুরো বিশ্বকেই এখন আতংকিত ও সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশাল জনগণও নানাভাবে এর শিকার। পাকিস্তানের পরিস্থিতি এই মডেলের পরিণতি দেখাচ্ছে। এই মডেলে ঢুকিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা খেলা চলছে প্রায় একদশক ধরেই। এখন তা আরও জোরদার হয়েছে। দখল ও স্বৈরশাসনকে যৌক্তিকতা দেবার জন্য প্রয়োজনে ‘মৌলবাদী জঙ্গী’ তৈরি করার ঘটনাও এখন প্রমাণিত। ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীও দেখায় যে, প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রই এসব ‘মৌলবাদী জঙ্গী’ লালন পালন করে, তার পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই মডেল প্রয়োগ করে, নিজ দেশের জনগণকে শৃঙ্খলিত রাখা দমনপীড়ন করা এবং বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করায় ভারতের কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী।
বলা হয়, ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও এইদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে সহযোগিতা করবে। কিন্তু ভারত বলতে তো সমরূপ কোন দেশ বোঝায় না। সেখানেও শ্রেণী, জাতি, বর্ণ ও লিঙ্গীয় বৈষম্য ও নিপীড়ন আছে প্রবলভাবে। তা বাংলাদেশ থেকে কোন অংশে কম নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। তাহলে যেদেশে সরকার সেইদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিককে নিপীড়ন ও বৈষম্যের মধ্যে রাখে তারা আরেক দেশে শান্তি,গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কী সহযোগিতা করতে পারে? তাছাড়া সাংবিধানিকভাবে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হলেও এই রাষ্ট্রকে কোনভাবেই অসাম্প্রদায়িক বলা যায় না। সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী ভাবধারার ওপর ভর করেই সেখানে বিকশিত হয়েছে বিজেপি ও উগ্র ধর্মান্ধ হিংস্র বর্ণবাদী গোষ্ঠী। ভারতের সেই হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী ‘মৌলবাদী’ বা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের দমন করবে কে? বাংলাদেশ ও ভারতে, দুই ধর্মের আবরণে হলেও,একটি আরেকটির অনিবার্য মিত্র কিংবা পুষ্টিদাতা। ভারতের নৃশংস সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সমার্থক নাম- নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট দাঙ্গার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা বহুভাবে প্রমাণিত হলেও আইনের রায়ে এখন তিনি নির্দোষ। এই রায়ের ফলে ‘দায়মুক্ত’ মোদীর এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে আর কোন বাধা নেই।
ভারতের রাজনীতি অঙ্গনের সব লক্ষণই বলছে মোদীর বিজেপি বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মোদীর প্রবল সমর্থক ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী;ভিসা নিয়ে নাটক হলেও মার্কিন ইউরোপীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মোদীর পক্ষেই সরব। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও কুশাসন বিজেপি আর মোদীর জন্য পথ খুলে দিয়েছে। প্রয়োজনে কংগ্রেসও ধর্মকে ব্যবহার করতে পিছপা হয় না। একজনের ওপর অতীষ্ঠ হয়ে জনগণ আরেকজনের হাতের মুঠোয় যাচ্ছে। আর ভারতের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশেও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করছে। গত একবছরে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলী বিজেপি-কে অনেক রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। শোষণ বৈষম্য ও নিপীড়ন ভরা এই ভারতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তাহলে কোন বাংলাদেশ তৈরি করবে?
ভারত বাংলাদেশকে সিকিম বানাবে এরকম আশংকাও সমাজে আছে। এরকম কোন সম্ভাবনা নেই। কেননা, এর চাইতে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কাজের। দায় নেই, সুবিধা বহুবিধ। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশকে ঘেরাও করে ভারতের শাসকেরা পুরো দেশের একমাথা থেকে অন্যমাথা নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় ট্রানজিট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস এখন ভারতের প্রভাব বাড়ছে, চার শতাধিক বায়িং হাউজ ভারতেরই। শিক্ষা, চিকিৎসা, মিডিয়া, বিনোদন জগতেও তাদের প্রভাব অনেক, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নানা আয়োজন চলছে। ভূমি ও বসতি বাণিজ্যেও অনেক প্রস্তাব আছে। বিদ্যুৎ খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার নানা প্রকল্প কাজ করছে। নদী বিনাশী আরও তৎপরতা আমরা দেখবো সামনে। বাণিজ্য অসমতা দূর করবার উদ্যোগ জোর পাবে না, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা জুনিয়র পার্টনার হয়েই খুশি থাকবেন হয়তো।
ভারতের বৃহৎ পুঁজির জন্য উপনিবেশ দরকার। তবে এইকালে এককভাবে উপনিবেশ রক্ষা ভারতের জন্য সম্ভব নয়। তার দরকার যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের সমর্থন। ভাগবাঁটোয়ারায় খুশি হলে এই দেশগুলো ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অসম্মত হবে না। জনগণের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যই বরং দেখবো আমরা। তখন বাংলাদেশের জনগণকেই ঐসব দেশের জনগণের সাথে সংহতি প্রতিষ্ঠা করে মোকাবিলা করতে হবে এই বাস্তবতাকে। বলাই বাহুল্য,লুটেরা শক্তির এই দল ঐ দল সম্পর্কে মোহমুক্তি ছাড়া দাসত্বের নতুন পুরনো শৃঙ্খল থেকে আমাদের মুক্তি সম্ভব হবে না।
আনু মুহাম্মদ, আমাদের বুধবার