মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলাচিঠি গোলাম মাওলা রনির

0

43280_rony460মান্যবর জনাব, সালাম ও শুভেচ্ছা। আমি আপনাদের রাজ্যের ুদ্র এক বাসিন্দা, যার তিন-তিনটি ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ে। তারা সবাই রাজধানীর সবচেয়ে সেরা স্কুলগুলোতে পড়ে এবং পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে তাদেরকে আপনি ভালো ছাত্রছাত্রী না বলে পারবেন না। তারা এখনো ইয়াবা-ফেনসিডিল কিংবা অন্য কোনো নেশায় আক্রান্ত হয়নি; কিন্তু তাদের আশপাশে যে বিশাল নেশার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তাতে হতভাগ্য পিতা হিসেবে এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে পারছি না। শুনেছি আপনার আব্বা কেমন লোক ছিলেন; আপনি নিজেও অসম্ভব সজ্জন এবং অতিশয় সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে আপনার প্রাণের সম্পর্ক আজন্মÑ তাই তাদের নৈতিক ভিত্তি এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে বেখবর নন। আর এই বিশ্বাসেই অনেক সাহস করে আপনাকে পত্র লিখছি। মাননীয় মন্ত্রী, আমার ভুল হলে অগ্রিম ক্ষমা চাই; কিন্তু দোহাই আল্লাহর, আপনি ুব্ধ হবেন না! কিংবা আমায় জেলে পাঠাবেন না।
আমি আপনার পরিচালনাধীন শিক্ষানীতি, শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষার সর্বনিকৃষ্ট মানের কারণে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার ভয় হচ্ছে, গত পাঁচ-ছয় বছরে যে পদ্ধতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয়েছে এবং যেভাবে তাদের হাতে বিনাপরিশ্রমে উন্নত পদ্ধতির নাম করে জিপিএ ৫ ও গোল্ডেন জিপিএ সংবলিত সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয়েছে, তাতে এ জাতি নিশ্চিত পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। আপনি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, আপনার জীবনসায়াহ্নের অন্তিম মুহূর্তে এসব ছেলেমেয়ে যখন দেশের নেতৃত্ব দেবে, তখন একটি ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থার কুফলের দুর্গন্ধ নিতে নিতে আপনি হয়তো জান্নাতুল ফেরদাউসের দিকে পা বাড়াবেন।
আপনি মাধ্যমিক স্তরের এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কতজন টিনএজ ছাত্রছাত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা, ভাবনা এবং পারিবারিক সম্পর্ক সম্পর্কে জানেন, তা আমার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঢাকা কলেজের গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের জনৈক ছাত্রের সাথে কথা হলো। জিজ্ঞেস করলামÑ বলো তো বাবা, হজরত শাহজালাল রহ: কে ছিলেন? ছাত্রটি কোনোরকম জড়তা এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখাল না। ঝটপট উত্তর দিলো, সম্ভবত তিনি কোনো নবী বা রাসূল ছিলেন। ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, সে আমার সাথে মশকারা করছে না তো! না, সে মশকারা করেনি; অত্যন্ত সম্মান ও বিনয় নিয়েই আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, চীনের রাজধানী কোথায়? সে বলল, জানি না। আদরের স্বরে বললামÑ বাবা, টোকিও বা বেইজিংয়ের নাম শুনেছ কি? সে বলল, নাম দুটো বেশ পরিচিত পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মনে মনে কৌতুক বোধ করলাম এবং ধন্যবাদ দিতে থাকলাম তার শিক্ষক-শিক্ষিকা, পিতামাতা এবং সর্বোপরি আপনাকে। ছেলেটি ছিল অতিমাত্রায় বিনয়ী, স্পষ্টবাদী এবং নির্ভীক সত্যবাদী। তাকে বললামÑ আচ্ছা সোনা! তোমরা যখন বন্ধুবান্ধব একত্র হও, তখন কী নিয়ে আলাপ করো? সে বললÑ ফেসবুক, গার্লফ্রেন্ড এবং আরো অনেক কিছু, যা আপনাকে বলা যাবে না। তোমরা কি নিজেদের ভবিষ্যৎ এবং পিতামাতার আয়রোজগার, হাল-হকিকত নিয়ে আলোচনা করো না! এবার সে আমার মুখের দিকে তাকাল এবং উন্নত শিরে বলল, আমাদের টাকা দরকার, আব্বা-আম্মার কাছে চাই। না দিলে খারাপ ব্যবহার করি, কখনোসখনো বাসা থেকে চুরিও করি। আবার বন্ধুদের কেউ কেউ জোর করে আদায় করে নেয়। কোনো কোনো বন্ধুর বাবা-মা তো ভয়ে মাসের এক তারিখেই হাতখরচার টাকা ছেলেমেয়েদের হাতে দিয়ে দেন। আর এখন কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করব!
মাননীয় মন্ত্রী, এবারের এইচএসসি পরীক্ষার সময় দেখলামÑ ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার রাতে পড়াশোনা না করে ফেসবুক চালাচ্ছে। সেখানে নাকি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। অনেকে আবার প্রশ্নপত্রের উত্তরও আপলোড করে দিয়েছে। রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে এসব নিয়ে মারামারি-হাতাহাতির মতো লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটে গেছে। ছেলেমেয়েরা বইপত্র না পড়ে কেবল মোবাইল, আইপ্যাড, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার সেটে প্রশ্নপত্র বের করে ফেলে। কেউ কেউ নিকটস্থ ফটোকপির দোকানে গিয়ে কী যেন সব নিয়ে আসে। এসব প্রশ্নপত্রের উত্তর যে বই থেকে বের করবে সেই পরিশ্রমটুকুও সোনামণিরা করতে নারাজ। তারা ফোন করে কোনো বন্ধু বা হাউজ টিউটরের কাছ থেকে উত্তরগুলো সংগ্রহ করে এবং বীরদর্পে পরীক্ষার হলে চলে যায়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ত্রিমাত্রিক নাটক জমে উঠেছে এই বঙ্গদেশে। অর্থকড়ির লেনদেনকে যদি প্রথম মাত্রা ধরেন তবে দ্বিতীয় মাত্রা হবে ছেলেমেয়ের শিক্ষার মান নিচে নেমে যাওয়া, অন্য দিকে তৃতীয় মাত্রা হলো একেবারেই অভিনব। তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসা এবং অনৈতিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র। বিষয়টি আগে জানতাম না। এটি যে হতে পারে, তা-ও কোনো দিন ভাবিনি। আমার এক হতভাগ্য বন্ধু যখন ঘটনাটি বলল তখন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। ঘটনাটি ঘটেছিল আমার বন্ধুর মেয়েটিকে নিয়ে। রাজধানীর একটি নামকরা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং বাবা-মায়ের বাধ্যগত সন্তান হিসেবেই মেয়েটির পরিচিতি ছিল সর্বমহলে। হঠাৎ করেই কী যেন হয়ে গেলÑ একদম লেখাপড়া ছেড়ে দিলো।
সারা দিন টিভি দেখে, খিলখিলিয়ে হাসে এবং মায়ের গলা ধরে গভীর আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সাথে ঘোষণা দিতে থাকে সে অবশ্যই গোল্ডেন জিপিএ পাবে। বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী ভারি ভাবনায় পড়ে গেলÑ এ কী করে সম্ভব! লেখা নেই, পড়া নেই; অথচ গোল্ডেন জিপিএ! এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েটা বেশ বড় হয়েছে। ফলে বাবা-মা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে মারধর করতে পারে নাÑ কেবল বকাঝকা করেই নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরই মধ্যে মেয়েটি তিন দিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে গেল। পুরো পরিবার পাগল হওয়ার উপক্রম। লাজলজ্জার ভয়ে ঘটনার কথা কাউকে বলতে পারল না। পুলিশকেও কিছু বলল না। তিন দিন পর মেয়েটি ফিরে এলো। তার সারা শরীর আর মনে তখন খুশির জোয়ার। সে প্রশ্নপত্র জোগাড় করে এনেছে। হতভাগ্য বাবা-মা শোকে-দুঃখে, অপমানে কপাল চাপড়াতে লাগল। একটু সুস্থ হওয়ার পর জানল আসল ঘটনা। একটি ছেলে মাসকয়েক আগে মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় এই বলে, সে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র জোগাড় করে দিতে পারবে। আর এতেই পটে যায় মেয়েটি।
হে রাজন! আপনি নিশ্চয়ই ইদানীংকালে ভিকারুননিসা, অগ্রণী, উত্তরা মডেল কিংবা অন্যান্য বালিকা বিদ্যালয়ের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে যাননি। যদি যান, তবে দেখবেন রঙ-বেরঙের বখাটেরা দলবেঁধে সেখানে কিরূপ তাণ্ডব চালায়। আমার মেয়েটিকে স্কুলে দিয়ে আসতে কিংবা নিয়ে আসতে গিয়ে প্রায়ই ওসব দৃশ্য দেখি। অসহায় পিতা হিসেবে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আমার তেমন কিছু হয়তো করার নেই; কিন্তু মনের যন্ত্রণা দূর করতে না পেরে দিনকে দিন নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে এক অসহায় প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি। প্রতিটি বিদ্যালয়ের আশপাশের দোকান এবং ফুটপাথে বসা দোকানগুলো একেকটা অপরাধের ডিপো। এখানে বখাটেরা বসে থাকে এবং মেয়েদের আকর্ষণ করার নানা রকম ফন্দিফিকির করতে থাকে। দোকানগুলোতে টাকার বিনিময়ে মোবাইল ভাড়া পাওয়া যায়। এসব মোবাইল দিয়ে ফোন করা, ইন্টারনেট চ্যাটিং, ফেসবুক চালানো এবং নানা রকম অশ্লীল ভিডিও দেখানো হয়। অনেক মেয়ে কাস ফাঁকি দিয়ে ওইসব দোকানে যায় এবং একসময় বখাটেদের খপ্পরে পড়ে।
আপনার জন্য আরো ভয়াবহ খবর হলো, বড় বড় স্কুল-কলেজের আশপাশেই গড়ে উঠছে মাদক সাম্রাজ্য। গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনের মতো মারাত্মক সব মাদকের জন্য স্কুলগামী তরুণ-তরুণীদের আর কষ্ট করে দূরে যেতে হয় না। দালালদের মাধ্যমে তারা অতি সহজেই এসব পেয়ে যাচ্ছে। উত্তরা, গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার অনেক শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণী মাদকদ্রব্যের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। ফলে ওই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এ নিয়ে অভিভাবকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতিটি পরিবারেই চলছে বোবাকান্না।
আপনি যদি কোনো একদিন বিকেলে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে যান তবে দেখতে পাবেন অসংখ্য তরুণ-তরুণী যাদের বয়স ১৩ বছর থেকে ২৫-২৬ বছরের মধ্যে, তারা পাশাপাশি বসে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার প্রতিযোগিতা করছে। আপনি যদি আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করেন এবং সূর্য ডোবার পর পুনরায় লেকের পাড়ে চক্কর দিতে থাকেন, তবে দেখতে পাবেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন দয়া করে লেকপাড়ের সব লাইট হয় বন্ধ করে দিয়েছে, নয়তো নষ্ট করে রেখেছে অথবা বেশির ভাগ জায়গায় লাইটই স্থাপন করেনি। ফলে অন্ধকারের মধ্যে গুটিসুটি মেরে অভদ্র তরুণ-তরুণীরা যা শুরু করে তা দুনিয়ার অন্য কোথাও চলে না। আপনার সরকারের উদার পুলিশবাহিনী কী কারণে যেন লেকপাড়টিকে অশালীন কাজের উন্মুক্ত মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। এই মঞ্চে দিবারাত্র ২৪ ঘণ্টা অশ্লীলতা, অনাচার, ব্যভিচার আর নীতিহীন যৌনাচারের মহড়া চলে। এসব দৃশ্যের ৯৯ ভাগ পাত্রপাত্রীই আপনার অধীনস্থ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। কাজেই ছেলেমেয়েদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে সহজেই আপনার সফলতার স্বর্ণপালকগুলো গুনতে পারবেন নির্দ্বিধায়।
হে ধর্মাবতার! ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে। আপনার রাজ্যে ইদানীং ধর্ম কী আর কল কী, তা জানতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে। ফলে ধর্মের কলের নড়াচড়া তো দূরের কথা, নামগন্ধও শোনা যাচ্ছে না। মসজিদে আজান হচ্ছে, মুসল্লিও আগের চেয়ে বেশি। মন্দিরের পূজারীদের ডাঁটফাট দেখলে মনে হয় এ বছর পূজা জমবে বেশ। পাড়া-মহল্লায় বড় বড় মসজিদ হচ্ছে, মন্দিরের সংখ্যাও নেহাত কম নয়; কিন্তু কোথায় যেন গলদ। মানুষের মন থেকে দিনকে দিন ধর্মবোধ উঠে যাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষা কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আজ আর সকাল হলেই মসজিদগুলো মক্তবে পরিণত হয় না। বাড়িতে বাড়িতে গৃহবধূ এবং গৃহকর্তা সাতসকালে দুলে দুলে কুরআন পড়েন না। অবোধ শিশুরা দলবেঁধে আমপারার তালিম নেয়ার জন্য মসজিদে ছুটে যায় না। আরবি হরফ কিংবা বর্ণমালা আজ আর মুসলিম পরিবারগুলোতে মর্যাদার সাথে উচ্চারিত হয় না। সব কিছুর মধ্যেই রাষ্ট্রীয় মদদে তালেবান কিংবা জঙ্গি শব্দমালা এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে ধর্মহীনতাই যেন মর্যাদার প্রতীক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
আপনার শিক্ষালয়গুলোতে এখন কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা কি একবারও হাতে-কলমে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? আমার মাধ্যমিক স্তর কেটেছে অজপাড়াগাঁয়ে। আমাদের সময়ে ছেলেমেয়েরা সাত-আট মাইল পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসত। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর পায়ে স্যান্ডেল থাকত না। সবার পোশাক-আশাকই ছিল মলিন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাস। দুপুরের বিরতির সময় একটু টিউবওয়েলের পানি খেয়েই ছেলেমেয়েরা তৃপ্ত হতো। স্কুলড্রেসের কথা তো কল্পনাই করা যেত না। বিদ্যালয়গুলোতে বসার বেঞ্চ ছিল না। ছিল না কোনো বেড়া। টিনের চালের ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো এসে ছেলেমেয়েদের মুখ উজ্জ্বল করত এবং বর্ষাকালে করত সিক্ত। এত কিছুর পরও তখন আমরা পড়তাম এবং জানতাম দেশ-বিদেশের অনেক কিছুই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, নবম শ্রেণীতে থাকতেই পাবলো নেরুদার কবিতা এবং উইলিয়াম সমারসেট মমের লেখা পড়েছি। এ ছাড়া শেখ সাদি, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নামকরা লেখকের ভালো ভালো গল্পও পড়ে ফেলেছিলাম। আজকের দিনের বাস্তবতা হলো, নবম-দশম শ্রেণীর বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই এসব লেখকের লেখা তো দূরের কথা, তাদের নামই ঠিকমতো জানে না।
মাননীয় মন্ত্রী, আমি খুব ছোট মানুষ। আমার বিদ্যাবুদ্ধির দৌড়ও নিতান্ত সীমিত। তার পরও মনে হচ্ছে, আমরা বোধ হয় এক মহাভুল করে ফেলেছি এবং সেই ভুলের পথ ধরে সগৌরবে পতনের দিকে ছুটে যাচ্ছি। শিক্ষা বলতে যদি বই বিতরণ, নতুন নতুন ভবন নির্মাণ, শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি, নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির সফলতা দেখানোর জন্য ঢালাওভাবে পাসের হার বৃদ্ধিকে বোঝায়, তাহলে অবশ্যই আপনি সার্থক; কিন্তু শিক্ষা বলতে যদি শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ এবং জ্ঞানভাণ্ডারের পূর্ণতাকে বোঝায় তবে আপনি ব্যর্থ। আপনার শিক্ষার্থীরা আপনার মতো শিক্ষা গ্রহণ করছে না। আপনি যেভাবে পিতামাতা, পরিবার-পরিজন এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল; সেভাবে একালের শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম দায়িত্ববোধেও অনুপ্রাণিত হচ্ছে না। এদের দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান, মুরব্বিকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করার মানসিকতা, জ্ঞানার্জনের আকাক্সা দিনকে দিন লোপ পেতে পেতে শূন্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেবল জিপিএ ৫ প্রাপ্তির কৌশল এবং অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই শিখছে না।
মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষার উন্নয়ন এবং এর বিকাশের রাজদণ্ড আপনার হাতে। আপনি সফল হলে ১৭ কোটি মানুষ সফল আর আপনি ব্যর্থ হলে পুরো জাতিই ব্যর্থ। কাজেই আপনাকে হতোদ্যম করলে আমাদেরই সমূহ ক্ষতি। আমরা চাই, আপনি এমন কিছু করুন যাতে ছেলেমেয়েরা বইপত্রের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। তারা রাতবিরাতে ঘরের বাইরে থাকার চেয়ে শিক্ষালয়ে গমন এবং লেখাপড়াকেই বেশি উপভোগ্য মনে করে। তারা যেন বড়কে শ্রদ্ধা এবং ছোটকে স্নেহ করতে শেখে। তাদের দু’চোখে যেন বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্নমালা জ্বলজ্বল করতে থাকে। তারা যেন পঠিত বিষয়ের মধ্যেই খুঁজে পায় দেশপ্রেম আর পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার শিক্ষা। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পিতামাতার মতো শ্রদ্ধা করতে শেখে এবং পিতামাতাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। অন্য দিকে তারা যদি তাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নির্ভরতা প্রকাশ করতে না শেখে, তাহলে সব শ্রমই একদিন পণ্ড হয়ে যাবে প্রকৃতির অপার লীলাখেলায়।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনাকে সুমতি দান করেন। মহান রব যেন আপনার চেতনাশক্তিকে সদাজাগ্রত রাখেন এবং ভালো-মন্দ বোঝার পর্যাপ্ত ক্ষমতা দান করেন। তিনি যেন আপনার শক্তি ও সামর্থ্যকে বাড়িয়ে দেন ভালো কাজ করার জন্য এবং মন্দ কাজ করার সব পথ রুদ্ধ করে দেন। আপনার অন্তর যেন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয় এবং সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার জন্য আপনার চিত্ত যেন চঞ্চল হয়ে ওঠেন এই দোয়া করে শেষ করছি।
ইতি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More