নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। মুক্ত হয়ে তিনি দেশে ফিরেন ১০ই জানুয়ারি। অবিসংবাদিত নেতার প্রত্যাবর্তনে বিমানবন্দরে লাখো মানুষের ঢল। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) সংবর্ধনার আয়োজন। একটি খোলা ট্রাকে চড়ে বঙ্গবন্ধু চার নেতাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে রওনা হলেন জনসভাস্থলে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অংশে শারমিন আহমদ লিখেছেন, মুজিব কাকুর পাশেই আনন্দে উদ্বেলিত আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ মুজিব কাকু আব্বুর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, ‘তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হব’।
ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে সদ্য প্রকাশিত তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইতে পঞ্চম পর্বে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সরকার গঠনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি আরও লিখেন, মুজিব কাকুর উদাসীনতায় আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) আহত হয়ে ছিলেন। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কেন জানতে চাননি কারা ছিলেন স্বাধীনতার শত্রু আর কারা ছিলেন স্বাধীনতার মিত্র। গোলাম আযমসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ বিস্তারিত বর্ণনায় আরও লিখেছেন, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি জনগণ-মন-নন্দিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষের ঢল চারদিকে। তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য তাঁরা ব্যাকুল। নেতাকর্মী পরিবৃত বঙ্গবন্ধু উঠলেন খোলা ট্রাকে। লাখ লাখ জনতার প্রাণঢালা অভিনন্দনের মাঝ দিয়ে ট্রাকটি ধীর গতিতে চলল রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে যার নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভবিষ্যতে এর সঙ্গে হয়তো স্বাধীনতা পার্ক নামকরণ যুক্ত হবে) উদ্দেশে। সেখানে তিনি ভাষণ দেবেন। মুজিব কাকুর পাশেই আনন্দে উদ্বেলিত আব্বু দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ মুজিব কাকু আব্বুর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, ‘তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হব!’
১২ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় আম্মাসহ আমরা বঙ্গভবনে গেলাম। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আব্বু মুজিব কাকুর কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার সমর্পণ করলেন। উদ্দীপ্ত ঝলমলে হাসিভরা মুখে আব্বু বললেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তারই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতার এক কোনায় আমার নামটা লেখা থাকবে।‘ আম্মার পাশে বসে আব্বুর হাসিভরা গৌরবদীপ্ত মুখ, মুজিব কাকুর আত্মপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তি ও চারদিকের আনন্দঘন পরিবেশ দেখে সেদিন মনে হয়েছিল আর শঙ্কা নেই। বাংলাদেশের সুদিন বুঝি ফিরে এলো।
বইয়ের অপর এক অংশে শারমিন আহমদ পিতা তাজউদ্দীন আহমেদের হতাশার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, আমার নবীন কৈশোরে যখন উম্মিলিত হচ্ছে নতুন স্বপ্ন, নতুন জগৎ ও জিজ্ঞাসা, আব্বু তখন মহাব্যস্ত স্বাধীনতার জ্যোতির্ময় স্বপ্ন, সাম্যবাদী ন্যায়বিচার-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে। ওই সংগ্রামে আব্বু ক্রমশই একা হয়ে পড়েছিলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মুজিব কাকু কখনোই আব্বুর কাছে জানতে চাননি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ঘটনাবলি। কখনোই জানতে চাননি যে তার অবর্তমানে আব্বু কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন; তাঁকে কি ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল; কারা ছিল স্বাধীনতার শত্রু, কারা মিত্র। রহস্যজনকভাবেই বিষয়টি জানতে চাওয়া সম্পর্কে তিনি নীরবতা পালন করেছেন। মুজিব কাকুর উদাসীনতায় আবু হয়েছেন আহত, মর্মাহত তবু হাল ছাড়েননি। অবিরাম চেষ্টা করেছেন মুজিব কাকুকে সামনে রেখেই নবজাত বাংলাদেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। এ বিষয়ে এ নিয়ে একাধিকবার মুজিব কাকুর সঙ্গে কথাও বলেছেন। ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তাজউদ্দীন আহমদ দেশ পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে ন্যায়বিচার ও ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন তা উল্লেখ করে শারমিন লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মতোই হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশেও আব্বু সৃষ্টি করেছেন ন্যায়বিচার, ত্যাগ, সততা, সংযম ও সুদক্ষ নেতৃত্বের অপূর্ব দৃষ্টান্ত। দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি বিলীন করেছেন ব্যক্তিস্বার্থ বা অন্ধ ক্ষোভ। ’৭১-এর মার্চ মাসের এক কালরাতে আশ্রয়প্রার্থী আম্মাকে, তাঁর শিশুপুত্র ও কন্যাসহ কারফিউয়ের মধ্যে ঘর থেকে বিতাড়িত করেছিলেন যে আয়কর কর্মকর্তা তার পদোন্নতির অনুমোদন আব্বু করেছেন হাসিমুখে। আম্মাকেও বিষয়টি অবহিত করেছেন নির্দ্বিধায়। যোগ্য জীবনসঙ্গীর মতোই আম্মাও সেই সিদ্ধান্তে সহমত জ্ঞাপন করেছেন। অনুমোদনের ফাইলে আব্বু তাঁর শিশিরবিন্দুর মতো হস্তাক্ষরে লিখেছেন, ‘আমি তাঁর এসিআর-গুলো দেখলাম। চাকরিজীবনের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর পদোন্নতি পাওয়া উচিত। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বিতর্কিত ভূমিকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কারও প্রতি সন্দেহবশত কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। যদি তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে তবে তা আলাদাভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেহেতু নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ এখানে দেখানো হয়নি বা কোন প্রমাণও নেই, তাই আমি বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে না এনে তাঁর এই পদোন্নতি অনুমোদন করলাম।’
আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আব্বু চেয়েছিলেন যে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান সেনাদের বিচার হোক আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। যুদ্ধাপরাধী যদি বাঙালি হয়ে থাকে তাহলে তাকে নাগরিকত্ব থেকে বিচ্যুত না করে তার বিচার যেন হয় দেশের মাটিতে ও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী। পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী এজেডএম শামসুল আলম- যিনি ছয় দফা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন- ওয়াশিংটনে ট্রেনিংয়ে থাকার সময় তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। অনুতপ্ত ওই ব্যক্তি দেশে তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত এই মর্মে আবেদন করেছিলেন।
শামসুল আলমের বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও আব্বু তাঁর নাগরিকত্ব বহাল রেখে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। তারপর রাষ্ট্র যদি মনে করে তার বিচার করা উচিত তাহলে তাঁর বিচার হবে এই মত প্রকাশ করেন। বিষয়টিকে তিনি সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানের বরাত দিয়ে মুজিব কাকুর কাছে উত্থাপন করেন। ক’দিন পর মুজিব কাকু আব্বুকে তাঁর অফিসে ফোন করেন- বিষয়, শামসুল আলমের নাগরিকত্ব বাতিল সম্পর্কে আব্বুর মতামত। আব্বু মুজিব কাকুকে বলেন, ‘মুজিব ভাই, এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলার ছিল। আজকে শামসুল আলমের দরখাস্তের কারণে বলার সুযোগ হলো। প্রথম কথা, আমাদের কোনো অধিকার নেই যে মানুষটা বাংলাদেশে জন্মেছে তাকে দেশের নাগরিকত্ব থেকে বহিষ্কার করার। এটা অন্যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অন্যায় সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করা উচিত। দ্বিতীয় কথা, আমি শামসুল আলমের দরখাস্ত পাঠিয়েছি যেটা এখন আপনার কাছে আছে। সেটা দেখেন এবং সে যে অন্যায় করেছে এই কারণে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করার ব্যবস্থা করেন।’ আব্বুর যুক্তি ছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়নি। জার্মান নাগরিক হিসেবেই তাদের সমুচিত বিচার হয়েছে।
মুজিব কাকুকে তিনি বললেন, ‘গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এইসব লোক বিদেশে থাকলে তাদের শাস্তি তো হলো না, এই দেশের মানুষ তো জানতেই পারল না যে, তারা কি জঘন্য অপরাধ করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। সুতরাং দেশে তাদের আসতে হবে। দেশে ফিরে আসার পর তাদের বিচার করতে হবে এবং বিচারে যে শাস্তি হবে সেই শাস্তি তাদের দেয়া হবে। যদি কেউ বেকসুর খালাস পায় সেটা সে পাবে।’
ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে আইনের শাসনের প্রতি আব্বুর গভীর শ্রদ্ধা এবং নিজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রয়োগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আব্বুকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। ওই একই কারণে তাকে পদে পদে প্রচ- বাধার সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। বাধা এসেছিল মূলত তাঁর নিজ দলের উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকেই। তাঁদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা ও স্বৈরাচারী কার্যকলাপ নবজাত বাংলাদেশের প্রগতির পথে হয়ে দাঁড়িয়েছিল পর্বতসমান অন্তরায়। সূত্র: মানবজমিন