একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি রাতে দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দিয়ে আসছে বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল৷ ভবিষ্যতেও এই ধারা চলবে বলে জানিয়েছেন হোটেলটির বর্তমান মালিক৷ শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, মানব সেবায় শর্ত বর্ষ পেরিয়েছে আকবরিয়া হোটেল। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মের হাতিয়ার করার প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্নভাবে মানব সেবায় নিয়োজিত থেকেছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এ হোটেলটি।
১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিদিন প্রায় একশ গরিব ও আশ্রয়হীনদের বিনামূল্যে রাতের খাবার সরববরাহ করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। রাত সাড়ে ১০টা পেরুতেই সড়কের দুইপাশ দিয়ে জড়ো হতে থাকে কর্মহীন ও ক্ষুধার্তরা। শুধু তাই নয়, ৫০ টিরও বেশি মসজিদ, মক্তব ও মাদ্রাসা নিজস্ব টাকায় পরিচালনা করে আকবরিয়া হোটেল কর্তৃপক্ষ।
কয়েকজন স্থানীয় জানান, আকবরিয়া হোটেলের মালিক ছিলেন আলহাজ্ব আকবর আলী। তিনি ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৭৫ সাল পর্যন্ত) মানুষের সেবা করে নিজ সম্পদকে বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। পরবর্তীতে শাজাহান আলী, সিদ্দিকুর রহমান জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা, শাহানুর ইসলাম শাহীন, হোসেন আলী দুলাল, হাসান আলী আলালসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা আকবর আলীর দেখানো পথে চলেছেন। আকবর আলীর মানব সেবার ধারা অব্যাহত রেখেছেন তারা।
সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে করতে এক পর্যায়ে আকবরিয়া হোটেলটি দ্রুত উত্তরাঞ্চলসহ দেশব্যাপী ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। সীমিত লাভ রেখে ভাল ও পরিচ্ছন্ন খাবার বিক্রি করায় অল্প দিনেই আকবরিয়া হয়ে বগুড়ার হোটেল ব্যবসার একটি আদর্শ। স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতাদের ভিড় সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে আকবরিয়ার। তবুও মালিক পক্ষের সঠিক নজরদারি ও কর্মচারীদের শোভন আচরণ মুগ্ধ করে ক্রেতাদের।
বগুড়া রেলস্টেশন এলাকায় থেকে দীর্ঘ দিন ধরে গরীবরা এ খাবার খেয়ে রাত্রীকালীন ক্ষুধা নিবারণ করে আসছেন।
বগুড়া শহরের সাতমাথাস্থ আকবরিয়ার এ সেবা যেন কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, এমনটাই চাওয়া তাদের।
বগুড়ার সরকারী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর দ্বীপকেন্দ্রনাথ নাথ দাস, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী (ঠিকাদার) সাজেদুর রহমান মোহন, বগুড়া জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা পপন, হাউজিং (দোকান) ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেন সাদী থেকে শুরু করে বগুড়ার জেলা ও পুলিশ প্রশাসনহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সকলেই রাত্রিকালীন গরীব অসহায়দের খাবার খাওয়ানোসহ বিভিন্নভাবে মানব সেবায় আকবরিয়ার কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন।
আকবরিয়ার খাবারও মানও সর্বজন বিদিত। স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় মানসম্মত খাবার। সাবেক হোটেল ব্যবসায়ী এহসানুল বারী শাহীন জানান, হোটেলের ব্যবসা অনেকই করছেন। কয়জন কতটুকু লাভ নিয়ে কী মানের খাবার সরবরাহ করছেন, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। যেখানে বাসি ও পচা খাবার বলে কিছু পাওয়া যায় না, তার নাম হোটেল আকবরিয়া।
ব্যাংকার শোভা ও ব্যবসায়ী শামীম জানান, উত্তরাঞ্চলসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি হোটেলে ভাত খেয়েছি। এত অল্প খরচে এত উন্নমানের খাবার কোথাও খাইনি। এখানকার আলু, মাছ, কলা ও কালোজিরা ভর্তা সত্যই অসাধারণ। রান্না করা গোশতগুলো খেলে মনে হয় হোটেল নয়, বাড়ির তৈরী খাবার খাচ্ছি।
শিক্ষক সুলতান মাহমুদ, আবু জাফর ও ব্যবসায়ী সোহেলসহ কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, দেশে অনেক হোটেল আছে, তাদের জানা মতে এমন কোনো হোটেল নেই, যেখানে প্রতিদিন রাতে গরীব-দুঃখী ১০০ মানুষের জন্য পৃথক খাবার রান্না করা হয়। এটা দেশে একটি বিরল ঘটনা বলেই দাবি করলেন তারা।
কলেজ শিক্ষার্থী শাওন জানান, তারা অনেকদিন রাত ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে দই মিষ্টি কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন আকবরিয়ায়। হোটেলে উপস্থিত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সন্ধ্যার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।
আকবরিয়া হোটেলের ম্যানেজার শামীম তালুকদার ও বেকারি শাখার দেখভালের দায়িত্বে থাকা জিল্লুর রহমান , প্রতিদিন তাদের হোটেলে মান সম্মত প্রায় ৫ থেকে ৬ রকমের দইসহ কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৭ রকমের মিষ্টি তৈরি করা হয়।
আকবরিয়ার ১০টি শাখায় বিস্কুট, পাউরুটি, কেকসহ প্রায় ১৮০ রকমের বেকারি খাবার প্রস্তুত হয়।
হোটেলের আরেক ম্যানেজার মাহমুদ আওরঙ্গজেব জানান, তাদের আকবরিয়া আবাসিক হোটেলে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা দিয়ে বাথরুম সংযুক্ত ও আসবাবপত্র লাগানো রুমে মানসম্মত পরিবেশে একজন রাত্রী যাপন করতে পারেন।
একই সঙ্গে বিনা পয়সায় আগন্তকের জন্য পত্রিকা, সকালের নাস্তা ও তোয়ালেসহ বাথরুম সামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আকবরিয়া হোটেলের ইতিহাস সম্পর্কে মাহমুদ আওরঙ্গজেব বলেন, যুগে যুগে স্বীকৃতি যেটুকু পাওয়া গেছে-তা কেবল কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মহলসহ সাধারণ কিছু মানুষের কাছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো কিছুই পাওয়া হয়নি তাদের।
তার মতে, আকবরিয়াকে সম্মান দেখালে হয়তো দেশের আরও ব্যবসায়ীরা মানব সেবায় কাজ করতে উৎসাহ বোধ করতেন।
আকবরিয়া হোটেলের পরিচালক হোসেন আলী আলাল জানান, বাবার কাছ থেকে তারা শিখেছেন মানুষের জন্য কাজ করলে আল্লাহ তার জন্য করেন। তাই ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসার পাশাপাশি মানুষের জন্য কাজ করে যচ্ছি। জীবনে কখনও কাউকে এসব প্রচারের জন্য গণমাধ্যমে বিন্দুমাত্র অনুরোধ করা হয়নি।