গত বছরের এপ্রিলে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরির পর যখন সেই মঞ্চকে ঘিরে চলছে নানামুখী আলোচনা পর্যালোচনা এবং মঞ্চের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে দেশ বিদেশে রীতিমতো চলছে আলোচনার ঝড়, তখনই কোন এক সময়ে লেখাটি আমি লিখেছিলাম। আজ এতদিন পরে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিভক্তি নিয়ে যখন একইভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে, মনে হলো লেখাটি হয়তোবা পাঠকদের জন্য আবারও একবার তুলে ধরা যেতে পারে। সেই অনুভূতি থেকেই টাইমনিউজবিডির পাঠকদের জন্য লেখাটি পুনরায় দেয়া হলো:
“একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিশেষ করে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নি-সংযোগের মতো অপরাধের সাথে যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক প্রতিটি বিবেকবান মানুষই তা চান। আর সে কারণেই শুধুমাত্র একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের অনুভূতি নিয়ে শিশু, নবীন ও প্রবীণ তথা সর্বস্তরের মানুষের যে ঢল নেমেছে শাহবাগে, সচেতন সবারই এসব মানুষের প্রতি নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তবে, আন্দোলনের আড়ালে এখানে মদ, গাঁজার যে আসর বসে এবং রাতে প্বার্শবর্তী উদ্যানে আন্দোলণরত তরুন-তরুনীদের কারো কারো অসামাজিক কার্যকলাপ নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সে বিতর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা না হয় নাই করলাম। কারণ যেখানে যতটুকু ভালো, আর যতটুকু খারাপ তার প্রকৃত চিত্র একসময় প্রকাশ হবেই।
এবার ফিরে আসা যাক মূল আলোচনায়। শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কোন বিষয় পরিস্কার হলো এবং রাজনৈতিকভাবে এই আন্দোলন আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিই বা কিভাবে করলো-সে বিষয়ে। সবার কাছে বিষয়টি সহজে বোধগম্য করতে প্রথমেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের দিকে নজর দিতে হবে।
ন্যূনতম সচেতন প্রতিটি মানুষই একথা অকপটে স্বীকার করবেন যে, একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের সমর্থন পেয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দলটি জাতির পিতা হিসেবে সম্মান দিয়ে থাকে। তাকে বলা হয়ে থাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। আর এমনই একজন মহামানবের আদর্শে বর্তমানে চলছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যারা আওয়ামী লীগ করেন অথবা রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও আওয়ামী লীগে ভোট দেন, তাদের সবাই আওয়ামী লীগের এই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমির কারনেই দলটিকে লালন করেন। আর আওয়ামী লীগও সব সময় দলটির একাত্তরের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা বলে কিংবা বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যাক্তিত্বকে প্রচার করেই জনসমর্থন আদায় করে আসছে।
আওয়ামী লীগের এই ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকার কারণেই স্বাধীনতার পর পরই সিরাজ সিকদারের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, মেজর জলিলের মতো মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারকে গ্রেফতার ও নির্যাতন এবং রক্ষী বাহিনীর সীমাহীন জুলুম নির্যাতন সত্বেও মানুষ আওয়ামী লীগকে ছেড়ে যায়নি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে দেশ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের ওপর হামলা ও নির্যাতন এবং বিশ্বজিতের মতো নিরীহ ছেলেকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের সামনে নির্মমভাবে খুন হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে টিকে আছে কেবলমাত্র তার শক্ত ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভিত্তি ও বঙ্গবন্ধুর বিরাট ব্যাক্তিত্বের জোরে।
কিন্তু শাহবাগের আন্দোলন অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে অনেকটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের গণমানুষের নেতা নন, জাতির পিতা তো অনেক দুরের বিষয়। তিনি যে কেবলই একটি রাজনৈতিক দলের নেতা শাহবাগের আন্দোলন তাই প্রমান করলো। কারণ এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক রুপ দিতে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সেখানে যেসব স্লোগান দেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম ’জয় বাংলা’। সেখানে ’জয় বঙ্গবন্ধু’ বলা হচ্ছে না। অথচ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম, জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি ’জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। কিন্তু এই প্রথম শুনলাম শুধু জয় বাংলা। সত্যি অবাক লাগে, যাকে জাতির পিতা বলা হয়, যাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বলা হয়, তার নামটি বাদ দেয়া হলো একটি গণআন্দোলনকে অরাজনৈতিক রুপ দিতে ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে। আর সেই আন্দোলনকে পুলিশ পাহারা থেকে শুরু করে নানা উপায়ে সাপোর্ট দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
আন্দোলনের এ পর্যায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরন করা হচ্ছে। আন্দোলনের মূল পয়েন্টে তার বিশাল আকৃতির ছবিকে প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথচ যাকে জাতির পিতা বলা হয়, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না বলা হয়, তার কোন ছবি জাহানারা ইমামের পাশে শোভা পাচ্ছে না। তার অর্থ কী এটা নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত একটি গণ আন্দোলনে, সেই স্বাধীনতার মূল নায়কের ছবি দেয়া যাচ্ছে না এই কারনে যে এতে আন্দোলনটি রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হতে পারে এবং গণ গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। আর সেই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বর্তমান সরকারই। তার মানে বঙ্গবন্ধুর বিতর্কিত অবস্থানের বিষয়ে এতদিন বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত যে দাবি করে আসছিল তা এবার মেনে নিল আওয়ামী লীগ। সত্যি কথা বলতে এই আন্দোলন আওয়ামী লীগের ভিত্তিমূলে যে আঘাত হানলো, এই মুহুর্তে না হলেও অচিরেই দলটি তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূলত: দুটো রাজনৈতিক জোটেরই উপকার হলো। তাহলো বাম রাজনীতি এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি। কারণ শাহবাগের এই আন্দোলনকে যতই অরাজনৈতিক রুপ দেয়া হোক না কেন এর নেতৃত্বে যে বাম রাজনীতির সাথে জড়িতরা আছেন তা দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের কাছেই দিবালোকের মতো পরিস্কার। তাই এই আন্দোলনের পটভূমিতে বামদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কিছ্টুা বাড়তে পারে কিংবা এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বামরা অবশ্যই দেশের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করবে।
অন্যদিকে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমীর, নায়েবে আমীর, সেক্রেটারি জেনারেলসহ সাত শীর্ষ নেতাই জেলে আটক। আর তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পরবর্তীতে দলের আরো বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হন। এছাড়া জামায়াতের সাথে আন্দোলন করতে গিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরেরও বেশ কয়েকশ নেতাকর্মী এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। এই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জামায়াত শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী প্রান হারান। কিন্তু এরপরও জামায়াত শিবির বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের মতো কর্মসূচী সফলভাবে পালন করেছে। শীর্ষ নেতাদের আটকের পর মাঠ পর্যায়ে জামায়াত শিবিরের যে তীব্র নেতৃত্বের বিকাশ হয়েছে এটা তারই প্রমান। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিশ্যতে জামায়াত শিবির যে অপ্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হতে পারে এমন ধারণা বোধহয় খুব একটা অমূলক হবে না।”
লেখক: সাংবাদিক
ই-মেইল: mkbablu@gmail.com