‘স্বর্গে’র বিলকিসের সঙ্গে

0

পুষ্টিহীনতা শিশুদের জন্য একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যা এড়াতে গর্ভবতী মায়েদেরও যত্ন নেয়া প্রয়োজন। ভয়াবহ কতটা হতে পারে  বাংলামেইলের পাঠক রাত্রি রেহমানের লেখা পড়ে দেখুন।

Shorgo Balika

গিয়েছিলাম বড় খালামনির বাসায়। কুড়িগ্রামের শিংরার ডাবড়ীতে। দুপুরের তাঁতানো রোদে খালার বাসায় পৌঁছেই সোজা রান্না ঘরে ছোঁ বসালাম। পানি পান করে গলাটা ভেজালাম। নিচে মোড়ায় বসবো। এমন সময় কে যেন বলে উঠলো, ওর বয়স ছ’বছর (!)।

আমি কথাটা খেয়াল করিনি। বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বললাম, ‘কে এ?’ মা বলল- ‘ওর কথাই তো বললাম, ওরই বয়স ছয় বছর।’ আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মজা করছে আমার সাথে। পরে কথা শুনে বুঝলাম মজা নয়। ওর বয়স, সত্যিই ছ’বছর!

অসম্ভব কৌতুহল নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। একটু আদর পেয়েই কোলে এসে বসলো। তার সঙ্গে আলাপ জুড়লাম। নাম জিজ্ঞেস করাতে ধীরে ধীরে করে আমার কানের খুব কাছে মুখ এনে খুবই স্পষ্ট করেই বলল ‘বিলকিস’। বেশ মজা পেলাম ব্যাপারটায়। কোলে করেই ঘরের দিকে নিয়ে আসলাম।

এখন ও আর আমার পিছু ছাড়তেই চাইছেই না। খুব মজা পেয়েছে হয়তো আমার কাছে। বেশ কিছু ছবিও তুললাম তার সঙ্গে।

আমার দুপায়ের মাঝখানে গা হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে, আর ও এতটাই ছোট যে বারবার ওর গায়েই উল্টে পড়ছিলাম। বাচ্চাটার দাঁতগুলো খুব ভালো লেগেছে আমার। মজা করেই বললাম, ‘দেখি বাবা, দাঁত বের করতো, দেখি।’  প্রথম দু’একবার লজ্জা পেল।’ (উচ্চতায় ছোট হলে কী হবে, বয়সের সাথে সাথে লজ্জা, ভয়, শ্রদ্ধা, বুদ্ধি সবই হয়েছে) পরের বার পোকা ধরা দাঁতেই ফিক করে হেসে দিল।

আহ! বাচ্চাগুলো স্বর্গ থেকে সোজা পৃথিবীতে আসে, কোত্থাও মোড় নেয় না।

তারপর ঘরে গেলাম, বুঝতে পারিনি বিলকিসও পিছু পিছু আসছিল। এত ছোট যে আমি হাঁটতে গিয়ে ওর গায়ে লেগে উল্টে পড়লাম। আর ও ব্যথা পায়নি। কিন্তু আমার এ চিৎপটাং অবস্থা দেখে হিহি করে হাসতে লাগলো। ওর হাসি দেখে নিশ্চিত হলাম, ও ব্যথা পায়নি। ওর হাসিটা মনে হলে, এখনো আপন মনেই হেসে উঠি আমি।

তারপর অনেক্ষণ তাকে আশপাশে দেখিনি তাকে। খাওয়ার সময় দেখলাম, কে যেন চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে, ও মিষ্টি খাচ্ছে। আর তখনও আমাকে দেখেই হাসছিল। আমারো মনে পড়ে গেল ‘চিৎপটাং’র কথা।

খাওয়ার পর আমরা ভাই-বোনেরা মিলে সিঁন্দুরমতির পাড়ে গেলাম। ফিরে এসে আবার আরেক নানুর বাড়িতে গেলাম। তারপর সেখান থেকে বাসায় ফিরলাম।

কিন্তু মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার মুখটা। এতটুকু একটা শরীর, কত মায়া! বিলকিসের মার মুখে শুনেছি, ও জন্মের আগেই পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে। জন্মের পর অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

বিলকিসের শরীরের অবস্থা দেখে ওর বাবা-মা সচেতন হয়। পরে আরো ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। ছোট বোনটা বিওর থেকে অনেক লম্বা। কিন্তু ও জন্মের পর যেমন ছিল, তেমনই আছে।

বিলকিস হয়তো লম্বা হবে না। হয়তো সুস্বাস্থ্য পাবে না সে। কিন্তু বুঝতে শিখবে নিশ্চয়ই। যখন সে বুঝবে, এর জন্য দায়ী সে না, তার বাবা-মা, তার পরিবার। সে কী করবে এখন? তার জবাব কী আছে বিলকিসের বাবা-মার কাছে? আমি চাইনা ও এমনই থাকুক। আমি আবারো সেখানে যাব, ওর জন্যই যাব। আমি চাইনা তখনও ওকে এভাবে থাকতে হোক। ও যেন ভাল হয়ে যায়। আর ভবিষ্যতের বাবা-মারা যেন, বিলকিসের এমন প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়।

লেখক: স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকা, রঙিন পাঠশালা
স্বেচ্ছাসেবক, স্পৃহা- বঞ্চিতদের পাশে সর্বদা, রংপুর।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More