‘আমার এ ছোট্ট জীবনে এটা ছিল ভয়াবহ রাত। আমি আর জীবনে হলে উঠব না। সিনিয়র ভাইদের জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই ভয় করে।’
এভাবেই ভয়ার্ত কণ্ঠে সেদিনের দৃশ্য তুলে ধরছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী। বিভীষিকাময় ওই রাতের ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় তার।
সেই রাতের দৃশ্য তুলে ধরে ওই শিক্ষার্থী বলেন, সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে দ্বিতীয় বর্ষের সিনিয়ররা মুজতবা আলী হলের ১১১ নম্বর রুমে ডাকেন আমাদের। আবাসিক তিনটি হলে নতুন ওঠা আমাদের ব্যাচের সবাইকে ডেকে নিয়ে আসা হয়। ওই রুমে সিনিয়ররা আমাকে ডাকলে প্রথমে যাইনি। পরে তারা আমাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে যান। ওই রুমে দ্বিতীয় বর্ষের সিআর আসিক হোসেনসহ ১০-১৫ জন ছিলেন। ওই রুমের সামনে সিসি ক্যামেরাও আছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার এই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতে ভাইয়েরা আমাদের ব্যাচের দুজনকে ধর্ষণের দৃশ্য সাজাতে বাধ্য করেন। এক শিক্ষার্থীকে মেয়ে সাজিয়ে তাকে ধর্ষণ করতে বলেন অপর একজনকে। ধর্ষণের দৃশ্য করানোর পর ওনাদের মনঃপূত না হওয়ায় এক ভাই বলে ওঠেন, তোরা তো ঠিকঠাক একজন আরেকজনকে ‘রেপ’ও করতে পারিস না বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। ওই সময়টাতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছিল। এমন দৃশ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা পরিবেশে পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি’।
তিনি আরো বলেন, ‘অন্যদিকে আমার আরেক ব্যাচমেটকে যৌনকর্মী সেজে তার দেহ প্রদর্শন ও খরিদদার ধরার অভিনয়ে বাধ্য করা হয়। দর-কষাকষির মাধ্যমে একজন যৌনকর্মীর দাম কীভাবে দু হাজার থেকে এক শ টাকায় নিয়ে আসা যায় ওই দৃশ্যও করতে বলেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি গানের সঙ্গে যৌন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি দেখাতে বাধ্য করেন আমাদের। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা যেভাবে ট্রেনে টাকা নেয় তার দৃশ্যেও অভিনয় করানো হয় অনেক বার’।
ওই ছাত্র আরো বলেন, ‘এ ছাড়া আমাদের নামের সঙ্গে যৌনতা সম্পর্কিত শব্দ যোগ করে বলতে বলেন। বলতে অস্বীকার করলে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেন, পাশাপাশি অবিরাম ধমক দিতে থাকেন সিনিয়ররা। আমি সিআর হওয়ায় আরো অনেক কিছু ঘটেছে (ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ)। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই ভয় করে আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাইদের জন্য’।
তবে এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একজন কথা বললেও বাকিরা ভয়ে কথা বলছেন না। তাদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন এই শিক্ষার্থী।
এর আগে মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে বুধবার ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বরাবর অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় র্যাগিংয়ে জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সেদিন তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. ফজলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাময়িক বহিষ্কৃতরা হলেন ব্যবসায় প্রশাসনের বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের মো. আপন মিয়া, মো. আল আমিন, মো. পাপন মিয়া, মো. রিয়াজ হোসেন ও মো. আশিক হোসেন।
জানা যায়, বহিষ্কৃতরা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তারা শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের অনুসারী বলে জানা গেছে।
এদিকে র্যাগিংয়ের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে বুধবার পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মো. খায়রুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। তদন্তের কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।