একুশে ফেব্রুয়ারি কিছু ভাবনা

0

ekusheআমাদের গণি ভাই, আবদুল গণি তালুকদারের কথা দিয়েই শুরু করি। সাত-সাতবার নদীভাঙনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সব জমি এবং পিতাকে হারিয়ে হিজলার বিখ্যাত তালুকদারের পো আমাদের বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছিলেন। আমরা তিন ভাইবোন তার হাতেই মানুষ হয়েছি। আমরা যখন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তাম, তিনি ঘুর-ঘুর করতেন, কখনো তিনি তার আদর্শলিপিটা খুলে শব্দের ওপর আঙুল চেপে জিজ্ঞেস করতেন কী। শেষের দিকে যুক্তাক্ষর ছাড়া তরতর করে পড়তে পারতেন। তিনি স্রেফ পুঁথি পড়ার জন্য লেখাপড়া শিখেছিলেন। সোনাভান, কালুগাজি চম্পাবতী কী জঙ্গনামা, শহীদে কারবালা এমনকি পথুয়া সাহিত্য বা হাটুরে সাহিত্য (অর্থাৎ স্ট্রিট লিটারেচার- বিশু কবীরকে ধন্যবাদ এই জাতীয় কবিতার অনবদ্য একটি সংকলন তৈরি করার জন্য) তিনি অতি উৎসাহে পাঠ করতেন। আরজ আলী মাতব্বর কি শাহ আবদুল করিমের অভিজ্ঞতা গণি ভাইয়ের মতোই- তারা অবশ্যই সশিক্ষিত। একজন গৃহস্থ এবং কায়িক শ্রমকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, অপরজন ভাটি অঞ্চলের পানি মেঘ মাটি ফসল আর বিস্তীর্ণ হাওর ও জনগণের সংগ্রামের ভাগিদার, এসব থেকেই নিজেকে তিনি মহাজনের নাও বলে ভাবতে পেরেছিলেন।
এবারের চিত্রটি বেশ পুরনো। বাংলা সাহিত্যের (এবং অসম উড়িষ্যা প্রভৃতি ভাষা-গোষ্ঠীরও) আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাওয়া গেল নেপালের মহারাজার গ্রন্থাগারে। সেই যুগের আরেক বিস্ময় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পাওয়া গেল এক ব্রাহ্মণের গোয়ালঘরের মাচায়। বুঝুন। না, এখানেই শেষ নয়, মধ্যযুগের শুরুতে আমরা দেখেছি হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞগণ রায় দিয়েছেন অষ্টাদশ পুরান রামস্য চরিতানি যদি বঙ্গভাষায় কেউ শ্রবণ করেন তিনি রৌবব নরকে যাবেন। কুরআন শরিফ বা হাদিস শরিফের বাংলা অনুবাদে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা তো ছিলই। সুলতানি আমলে কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ কী কাশীরাম যাকে মহাভারত মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনূদিত হয়েছিল। তখনই টনক নড়ে, বাঙালি মুসলমান এসব জানে আল্লাহ-রসূল চেনে না? যারাই কাব্য রচনায় এগিয়েছেন শাহ মোহাম্মদ সগীর কী শাহ বায়িজিদ খান, মোজাম্মেল কী ভানুÑ তারা আরজ করতে ভোলেননি যে, পুঁতি শেষ করে গুনাহগারের জন্য যেন দয়া করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর আবদুল হাকিম বেশ চড়া গলায় যেজন বাংলা ভাষার নিন্দা করেন সে কাহার জন্ম ‘নির্ণয় ন জানি।’ বুঝুন।
এইবার কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে নবাবী যুগ, কলোনি-ব্রিটিশ যুগ পেরিয়ে, পাকিস্তান যুগ পেরিয়ে এই সময়ের খবর যদি সঠিকভাবে দেয়া হয়, আর আবদুল হাকিম সাহেবের হাতে আবার কাগজ-কলম দেয়া হয় তিনি কী লিখবেন? না, অতটা কল্পনাশক্তি আমার নয়।
খাগের কলম, বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম, একসময় নিব-অলা দোয়াত কলম (এখন এসব তো এন্টিক্স প্রায়) পেরিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে পা রেখেছি আমরা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক কি প্রাইভেট, কত্ত ইস্কুল কলেজ, কত রকমের মাদরাসা- আবার রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রেডিও টেলিভিশন সিনেমা থিয়েটার হৈ হৈ কাণ্ড- কিন্তু বাংলা ভাষা?
ভারতচন্দ্র ‘যাবনী মিশাল’ বাংলায় মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে কাব্যচর্চা করেছেন, এখন? ইংরেজি মিশেল শব্দে কুলুবে না আরো কিছু যোগ করতে হবে। প্রমিত বাংলা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শুধু সংবাদই পরিবেশন করা হয়, টক শোগুলোতেও। নাটক-সিনেমায় প্রমিত বাংলা শোনার সৌভাগ্য কমই হয় আমাদের।
একসময় রেডিও শুনে, কলের গান শুনে বায়োস্কোপ দেখে প্রমিত উচ্চারণ শিখেছিলামÑ যেটুকু শিখেছিলাম এখন আয়োজন চলছে সেটুকুও ভোলানোর।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে, মাপ চাই, কয়েক দিন আমার এক নাতি বছর চারেক হবে হয়তো, স্কুল থেকে ফিরে যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে দু’হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ বলতে বলতে সে তাদের শোবার ঘরে গেল আবার একই সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, না সে দাঁড়ায়নি, আমিই থামালাম। ব্যাপার কী জানতে চাইলাম, ওর মা জানালেন, ক্লাসের আপা নাকি রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন।
এবার আমি শিশু-বিপ্লবীকে বুঝাচ্ছি ‘তারপর কী হলো ভাইয়া?’ তার অবিচল মুখ। ‘পুলিশ দ্রুম দ্রুম করে গুলি করে মেরে ফেলল, আর ওরা পুলিশের মাথা কেটে ফেলল।’
শেষ অংশটি স্কুল থেকে শেখা নয়, তার নিজের ক্ষোভের এবং রাগের প্রকাশ, সন্দেহ নেই।
বছর কয়েক আগে একটা পদ্য লিখেছিলাম, রাষ্ট্রভাষা সত্যি সত্যি বাংলাই চাই। আচ্ছা এখন কী লিখি। উপরের দিকে থুথু মারলে নিজের মুখটাকে কি বাঁচাতে পারব?
পুঁথির যুগ শেষ হয়েছে, বইয়ের যুগও ধমকি-ধামকির মধ্যে আছে। শিল্প-সাহিত্য পৃষ্ঠপোষক দাবি করে। একসময় রাজা-বাদশাহরা ভূস্বামী বা বিত্তবানেরা কবিকে (লেখককে) যথেষ্ট আর্থিক সমর্থন দিতেন। সব যুগ পেরিয়ে আমরা বর্তমানে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এখনো পৃষ্ঠপোষক পাঠক। এমনকি সদ্য প্রয়াত কবি কায়সুল হকের কয়েকটি পঙ্ক্তি উপহার দেই : আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের লেখাপড়া জানা লোকেরা সাহিত্যের পাঠক হয়ে উঠল না, যার ফলে জীবিকার জন্য লেখকদের অন্য কাজে সময় ব্যয় করতে হয়।
শামসুর রাহমানের মতো কবিকেও সাংবাদিকতার চাকরি করতে হয়েছে, যার দরুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের সাহিত্য।
কী মনে হচ্ছে! লেখাটি বেশ পুরনো, এখনো কি অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে?
লেখা পেশা নয়, লেখালেখি করে বউ-ঝির কথা বাদই দেই, নিজেরই আহার-বাসস্থান-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, প্রকাশকই কী করবেন, পাঠকই বা কী করবেন? উল্টোভাবেও চিন্তা করার সুযোগ আছে। বইমেলায় ঘুরে ঘুরে এসব এলোমেলো ভাবনা পেয়ে বসে। জট খুলছে না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More