বেশি কথা বললে, বেশি কর দিতে হবে। মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর বাড়তি হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করা হতে পারে আসন্ন বাজেটে। এ ছাড়া মূল্য সংযোজন কর কিছুটা বাড়ানো হতে পারে মোবাইলের সিম সংযোজনের ক্ষেত্রে। নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে। বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বসানো হতে পারে কর। বাড়তে পারে তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাতের ‘উৎসে কর’ হার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য নির্ধারিত বহুল আলোচিত ‘প্যাকেজ ভ্যাট’ পদ্ধতি বাতিল করা হতে পারে।
বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর দিতে হয় গ্রাহককে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, যেসব গ্রাহক একনাগাড়ে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলবেন, তাদের বিদ্যমানের চেয়ে আরও ১৫ শতাংশ বেশি মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। আসন্ন বাজেটে এই কর প্রস্তাব কার্যকর হলে যারা বেশি কথা বলবেন, তাদের বেশি কর দিতে হবে।
গ্রাহকদের ওপর চাপ আসবে না। কারণ সিম সংযোজনের কর মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো দিয়ে থাকে। যদিও এই কর কমানোর দাবি করে আসছে অপারেটরগুলো। জানা গেছে, দেশে এখন মোবাইল ফোন গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি ৪৭ লাখ। স্থানীয় পর্যায়ে সিগারেটের পর মোবাইল ফোন হচ্ছে রাজস্ব আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়াতে এসব কর প্রস্তাবের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব আসছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে। নতুন বাজেটে বেশ কিছু খাতে কর ছাড়ের প্রস্তাব করা হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হার কমানো হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির কর হার কমতে পারে। নতুন করে আরও কিছু খাতকে উৎসে করের আওতায় আনা হচ্ছে। আগামী ৪ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আজ শুরু হচ্ছে বাজেট অধিবেশন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, তাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ছাপানোর জন্য গতকাল বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অধিক সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অন্যতম বড় খাত আয়করে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট টাকা আদায় করা হবে আমদানি শুল্ক খাত থেকে। সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাই হবে এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। একই মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরাও। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, গত তিন বছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তাই এবার রাজস্ব আয় বাড়ানোই হবে সরকারের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে। অভিযোগ উঠেছে, রফতানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকাতে রফতানিমুখী শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
রফতানিকে উৎসাহিত করতে এখন তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসে কর কর্তন করা হয় শূন্য দশমিক ত্রিশ পয়সা। এর বাইরে অন্যান্য রফতানি খাতে এই কর হার শূন্য দশমিক ষাট পয়সা। নতুন বাজেটে পোশাক খাতের উৎসে কর বিদ্যমানের চেয়ে বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৮০ পয়সা ও অন্যান্য খাতে এক টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে।
এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, পেঁয়াজসহ জীবন রক্ষাকারী কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া আছে। সূত্র জানায়, শুল্কমুক্ত সুবিধার নাম করে এসব পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাই, এসব পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা রোধে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হতে পারে। বর্তমানে সারাদেশে ছোট ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত প্যাকেজে ভ্যাট দিয়ে থাকেন। এটা ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশনের জন্য বছরে ১১ হাজার টাকা। অন্য সিটি করপোরেশনে ব্যবসায়ীদের জন্য ৮ হাজার টাকা। জেলা শহরে ৬ হাজার টাকা এবং উপজেলায় ৩ হাজার টাকা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটে শুধু উপজেলার ছোট ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে বাকি সব শহর ও বিভাগীয় শহরে প্যাকেজ ভ্যাটের বিদ্যমান পদ্ধতি তুলে দেওয়া হতে পারে। প্রস্তাবিত এই বিধান কার্যকর হলে ছোট ব্যবসায়ীদের প্রকৃত লেনদেনের ওপর প্রযোজ্য হারে ভ্যাট দিতে হবে। এর ফলে তাদের ওপর করের চাপ বেড়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাবে বাজারে পণ্যের দামও বেড়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, আইএমএফ প্যাকেজ পদ্ধতিতে ভ্যাট দেওয়ার বিধান বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। তা ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনেও এই বিধান বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট কর হার সাড়ে ৪২ শতাংশ। নতুন বাজেটে এই খাতে করপোরেট কর হার কমিয়ে ৪০ শতাংশ হতে পারে। করপোরেট কর হচ্ছে আয়কর আদায়ের অন্যতম খাত। গত অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার কর পেয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকিং খাতে করপোরেট কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। এক সময়ে এই কর হার ছিল ৪৫ শতাংশ।