স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মানচিত্রে পুনরায় যুক্ত হলো ভূমি ও ভূমি সন্তানরা। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের দীর্ঘদিনের আলোচনার প্রেক্ষিতে দুই দেশই তাদের মধ্যে থাকা ছিটমহল বিনিময় করতে সম্মত হয়। ওই আলোচনারই চূড়ান্ত রূপ হিসেবে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫১টি এবং ভারত পেয়েছে ১১১টি ছিটমহল। ইংরেজিতে ‘Enclave’ এবং ‘Exclave’ নামে দুটি শব্দ আছে। শব্দদুটির আভিধানিক মানে ‘ছিটমহল’ হলেও কার্যত এরমধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। এনক্লেভ মানে হলো সেই ভূখন্ড যা মূলভূমির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে, অন্যদিকে এক্সক্লেভ মানে হলো মূলভূখণ্ডের বাইরের ভূখণ্ড যার চর্তুপাশে অন্য কোনো রাষ্ট্র অবস্থান করছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ পাচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর বাড়তি জমি এবং ভারত পাচ্ছে ৭ হাজার ১১০ একর জমি।
ভারত-বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশ আছে যারা এখনও ছিটমহল সমস্যায় আক্রান্ত। মূলত দেশ ভাগাভাগির সময়ে রাজনৈতিক কারণে এই ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলভূখণ্ডে থাকা মানুষের তুলনায় ছিটমহলবাসীর জীবনে সুযোগ সুবিধা কিছু নেই বললেই চলে। উল্টো তাদেরকে কোনো নাগরিক পরিচয়পত্রও দেয়া হয় না, কারণ দুই দেশের রাষ্ট্রনায়করাই তাদের নিয়ে দ্বিধান্বিত যে ওই মানুষগুলো আসলে কোন ভূমির মানুষ। মানুষকে মাপা হয় তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় পরিচয়ের মানদণ্ডে। যে কারণ ছিটমহলবাসীর কাছে তার ভূমির তুলনায় মূলভূখণ্ডের ভূমি অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে যায়। তবে কিছু ভিন্ন উদাহরণও আছে, সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
মেলিল্লা অ্যাণ্ড চেওটা, স্পেন
মেলিল্লা এবং চেওটা হলো মরক্কোর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলবর্তী দুইটি স্প্যানিশ শহর। মেলিল্লাকে সীমানা বানিয়ে ১৯ শতকে যখন স্প্যানিশ সীমান্তরেখা তৈরি হয়, সেই ১৬৬৮ সালের দিকে চেওটা শহরটি স্পেনের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। আফ্রিকার শরণার্থীরা এই শহরগুলোতে প্রবেশের জন্য অবিরাম চেষ্টা করতে থাকে, কারণ এই শহরগুলো ইউরোপের অংশ। এই কারণে স্পেন সরকার শহরগুলোর চর্তুপাশে তিন মিটার লম্বা কাটাতারযুক্ত বেড়া দিয়েছে এবং প্রহরার ব্যবস্থা করেছে।
কালিনিনগ্রাদ অবলাস্ট, রাশিয়া
কালিনিনগ্রাদ অবলাস্ট রাশিয়ার অংশ হলেও মূল রাশিয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। এর চর্তুপাশেই আছে লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ড। ঐতিহাসিকভাবে কালিনিনগ্রাদ ছিল মূলত পূর্ব প্রুসিয়ার অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই অংশটি জার্মানির দখলে ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন কালিনিনগ্রাদ দখল করে নেয়ার পর পোটসডাম চুক্তি অনুসারে ওই অংশটি রাশিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। ছোটো এই শহরটিতে অবস্থানরত সাবেক জার্মান নাগরিকদের প্রায় সবাইকেই হত্যা করা হয়েছিল এবং তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। যদিও বর্তমানে কালিনিনগ্রাদে প্রায় নয় লাখ চল্লিশ হাজার রুশের বসবাস।
জিব্রাল্টার, যুক্তরাজ্য
বিশ্বের অমীমাংসিত ছিটমহলগুলোর মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ স্পেনে অবস্থিত জিব্রাল্টার। জিব্রাল্টারের মালিক মূলত যুক্তরাজ্য এবং এটা একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রও। ভূমধ্যসাগরের ঠিক প্রবেশ মুখেই এর অবস্থান। ১৭১৩ সালে এই ভূখণ্ডটি যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছোটো এই শহরটিতে একটি বিমানবন্দর থাকায় খুব সহজেই এই শহরে পর্যটকরা আসতে পারেন এবং ভূমধ্যসাগরের নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন।
ভ্যাটিকান সিটি
ইতালির রাজধানী রোমের একেবারে বুকের মাঝে অবস্থিত এই ছোট্টো শহরটি। ১১০ একরের এই ভূখণ্ডে মাত্র ৮৪০জন মানুষের বসবাস। খ্রিষ্টধর্মের কাছে এই শহরের অনেক গুরুত্ব বিধায় রোমের সকল ক্ষমতাকাঠামো সহায়তা এই শহরকে দেয়া হলেও, ভ্যাটিকান মূলত একটি স্বাধীন শহর রাষ্ট্র। ১৯২৯ সালে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে এই শহরটিকে স্বাধীন শহররাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সান ম্যারিনো
দ্য রিপাবলিক অব সান ম্যারিনোর চর্তুপাশে আছে ইতালি। ২৪ বর্গমাইলের এই শহরটিতে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের বসবাস। বিশ্বের প্রাচীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সান ম্যারিনো নিজেকে দাবি করতেই পারে। কারণ সেই ৩০১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে অনেক কষ্টের বিনিময়ে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং সেই থেকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে।
লেসোথো
১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যের হাত থেকে স্বাধীন হয় দ্য কিংডম অব লেসোথো। ৩০হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ডটি বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেতরে অবস্থিত। দুই মিলিয়ন মানুষের এই রাষ্ট্রটি তার ক্ষুদ্র সীমানা নিয়ে স্বাধীনভাবে টিকে আছে। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ আজও এই ভূখণ্ডটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।
পয়েন্ট রবার্টস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটি ছোটো অংশ পয়েন্ট রবার্টস। কার্যত এই অংশটি কানাডার মালিকানাধীন হিসেবেই পরিচিত। সাগরপথে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পয়েন্ট রবার্টসের যোগাযোগ থাকলেও এখানে যেতে হলে লাগবে কানাডার অনুমতিপত্র। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের মধ্যকার যে সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তি অনুসারেই পয়েন্ট রবার্টস ছিটমহল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।
কাবিনদা, অ্যাঙ্গোলা
অ্যাঙ্গোলার একটি প্রদেশ হলো কাবিনদা। যদিও কাবিনদা একটি সরু রাস্তার মাধ্যমেই মাত্র ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সঙ্গে যুক্ত। ১৮৮৫ সালে পর্তুগিজ রাজতন্ত্রের বাইরে এসে কাদিনদা অ্যাঙ্গোলার অঙ্গভুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালে পর্তুগাল তাদের সকল কলোনিকে স্বাধীন ঘোষণা করে দেয় এবং সেই হিসেবে কাবিনদা অ্যাঙ্গোলার অংশ হয়ে যায়। কাবিনদার আয়তন প্রায় ৭২৭০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
অস ডি সিভিস, স্পেন
অস ডি সিভিস নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই স্পেনের অংশ। কিন্তু স্পেনের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় একে ছিটমহলের মর্যাদা দেয়া হয়। মূলভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাত্র একটি সরু রাস্তা হওয়ায় অস ডি সিভিসের সঙ্গে স্পেনের যোগাযোগ খুব একটা সহজ নয়। অস ডি সিভিস মূলত একটি ছোটো গ্রাম, যেখানকার জনসংখ্যা মাত্র ১০০।
জঙহলয অ্যান্ড ক্লেইনওয়ালসাতাল, অস্ট্রিয়া
জঙহলয এবং ক্লেইনওয়ালসাতাল অংশ দুটি অস্ট্রিয়ার অংশ। কিন্তু পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় বাস্তবিক কারণেই একে ছিটমহল বলা হয়। তবে এই শহরদুটোতে যেতে হলে অবশ্যই আগে জার্মানির অনুমতিপত্র নিতে হবে। জঙহলয শহরের জনসংখ্যা ৩০০ এবং ক্লেইনওয়ালসাতালের জনসংখ্যা আনুমানিক পাঁচ হাজার।